বীনা বলল, তোমাদের কোম্পানি বড় একটা কাজ পেয়েছে তাতে তুমি এত খুশি কেন? তুমি তো মাসের শেষে বেতনটাই শুধু পাবে। বাড়তি কিছু তো পাবে না।
লীনা বলল, আমাদের কোম্পানি কাজ পেয়েছে এইজন্যেই আমি খুশি। আমাদের অবস্থা যে কী খারাপ যাচ্ছিল। স্যার শুকনোমুখে অফিসে বসে থাকতেন। কী যে মায়া লাগত।
তোমার তো আপা মায়া বেশি। মায়ার বস্তা নিয়ে ঘুরবে না। একসময় বিপদে পড়ে যাবে। তোমার জন্যে একটা আনন্দ-সংবাদ আছে আপা।
কী আনন্দ সংবাদ।
ফিরোজ ভাই রাতে খেতে আসবে। কাজেই গোসলের পর ভালো একটা শাড়ি পরো আপা। যে শাড়ি তুমি পরবে বলে এনেছ, এই শাড়ি পরলে তোমাকে কাজের বুয়ার বোন বলে মনে হবে।
লীনা লজ্জিত গলায় বলল, মনে হলে মনে হবে। ও আসবে বলে ইস্ত্রি করা শাড়ি পরে বসে থাকতে হবে না-কি?
বীনা বলল, ফিরোজ ভাই তোমাকে যে শাড়িটা দিয়েছে ঐটা পরো। ফিরোজ ভাই খুশি হবে।
লীনা বলল, তোর কি ধারণা ও কী শাড়ি দিয়েছে মনে করে বসে আছে? এইসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। শাড়ি দিয়েছে কি-না এটাও তার মনে নেই।
বীনা বলল, মনে না থাকলে তুমি মনে করিয়ে দেবে। কায়দা করে একসময় বলবে –তুমি যে শাড়িটা দিয়েছিলে ঐটা পরেছি। আপা শাড়িটা নিয়ে আসি?
নিয়ে আয়।
তোমার স্যার আজ কী খাবার পাঠাবে?
জানি না কী পাঠাবেন। ভালো কিছু অবশ্যই পাঠাবেন। উনার নজর খুব উঁচু।
বীনা গম্ভীরগলায় বলল, আপা তুমি তোমার স্যারের যে-কোনো প্রসঙ্গ উঠলেই বেশ গদগদ ভাব কর। এটা আমাদের সামনে কর খুব ভালো কথা। ফিরোজ ভাই-এর সামনে কখনো করবে না। ছেলেরা এইসব জিনিস নিতে পারে না।
লীনা বলল, তোকে জ্ঞান দিতে হবে না।
বীনা বলল, এখন তোমাকে একটা দামী উপদেশ দেব। উপদেশটা শুনলে তোমার ভালো হবে।
কী উপদেশ?
দেরি না করে ফিরোজ ভাইকে বিয়ে করে ফেল। ব্যাপারটা অনেক দিন থেকে ঝুলছে। আর ঝােলা ঠিক হবে না।
লীনা ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল। এই নিশ্বাস তৃপ্তি এবং আনন্দের। তার ছোটবোনটা উপদেশ দিতে ভালোবাসে। উপদেশ দেবার এই স্বভাব সে পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। বাবা উপদেশ দিতে খুব পছন্দ করতেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও তিনি গম্ভীর ভঙ্গিতে উপদেশ দিতে চাইলেন আমার দুই মেয়ে কোথায়? তোমরা আমার কয়েকটা কথা শোনো। উপদেশ ভাবলে উপদেশ, আদেশ ভাবলে আদেশ। এই বলেই তিনি মাথা চুলকাতে লাগলেন। লীনার ধারণা কোনো উপদেশ তার মনে আসছিল না।
যত দিন যাচ্ছে, বীনা বাবার ফটোকপি হয়ে যাচ্ছে।
হাসান বাড়ি ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। মিস্তিরীকে গাড়ি দেখিয়ে ফিরতে দেরি হল। তার ইচ্ছা ছিল গোলাপ কিনবে। পান্থপথের সিগন্যালে গাড়ি অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। ফুল বিক্রি করা মেয়েরা ছুটে আসে। শস্তায় খুব ফুল পাওয়া যায়। দুশ টাকার ফুলে গাড়ির পেছনের সিট ভর্তি হয়ে যাবার কথা। বেছে বেছে আজই কোনো সিগন্যাল পড়ল না। হাসান একটানে চলে এল। গ্যারাজে গাড়ি রেখে কলিংবেলে হাত রাখতেই দরজা খুলে গেল। হাসানের স্ত্রী নাজমা মনে হয় দরজা ধরেই দাঁড়িয়েছিল। তার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। হাসান ভেবে পেল না নাজমা এত রেগে আছে কেন? রাগের কোনো কারণ কি সে ঘটিয়েছে? নাজমার কোনো আত্মীয়ার বিয়েতে তাদের দুজনের যাবার কথা ছিল–সে ভুলে গেছে। নাজমার বাবা বেলায়েত হোসেন চিটাগাং খাকেন, তিনি খুবই অসুস্থ। তার কি কোনো খারাপ খবর এসেছে?
নাজমা বলল, কটা বাজে জানো?
হাসান হাসিমুখে বলল, জানি না। সঙ্গে ঘড়ি নেই। ঘড়ি ফেলে গেছি।
অনুমান করতে পার কটা বাজে? সাড়ে নয়, কিংবা দশ।
হাসান শার্ট খোলার জন্যে বোতামে হাত দিয়েছে। নাজমা বলল, শার্ট খুলবে না।
হাসান বলল, ব্যাপার কী?
ব্যাপার কি তুমি জানো না?
হাসান তার মুখের হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সে তার স্ত্রীকে ভালো একটা খবর দেবে। তার জন্যে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। নাজমা রাগে গনগন করছে এই অবস্থায় তাকে বিশাল কাজ পাবার আনন্দময় খবর দেয়া যায় না।
হাসান বলল, ঘটনাটা কী বল তো?
অফিসে যাবার সময় তুমি দেখে যাওনি অন্তুর একশ দুই জ্বর।
জ্বর বেড়েছে না-কি?
তুমি বলে গিয়েছিলে– বিকেলে এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। বলেছ কি বলনি?
ভুলে গেছি। জরুরি একটা কাজ ছিল।
দেখে গেলে ছেলে জ্বরে ছটফট করছে তারপরেও ভুলে গেলে?
এখন জ্বর কত?
একশ চার পর্যন্ত জ্বর উঠেছিল, এখন একশ দুই।
তাহলে তো মনে হয় কমা শুরু করেছে।
কমা শুরু করেছে কি করেনি এই ডাক্তারি কথা আমি তোমার কাছে শুনতে চাচ্ছি না। এক্ষুনি অন্তুকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও।
এত রাতে ডাক্তার পাব? নটার দিকে তো ডাক্তাররা ক্লিনিক বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়।
বাড়ি চলে গেলে তুমি ডাক্তারের বাড়িতে যাবে।
আচ্ছা যাচ্ছি।
আমি তোমার অফিসে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম পাওনি?
আমি বিকেলে অফিসে ছিলাম না।
তুমি যে অফিসে ছিলে না। সেই খবর আমাকে অফিস থেকে দেয়া হয়েছে। তুমি তোমার পি. এ-কে নিয়ে বের হয়েছ তিনটার সময়। এতক্ষণ কি তার সঙ্গেই ছিলে? সারাক্ষণ গায়ে মেয়েমানুষের বাতাস না লাগালে ভালো লাগে না?
হাসান কিছু বলল না। অন্তু ঘুমুচ্ছিল। ঘুমন্ত অবস্থাতেই চাদর পেঁচিয়ে তাকে গাড়িতে নিয়ে তুলতেই সে চোখ মেলে হাসানকে দেখে হেসে ফেলে বলল বাবা। তার গা-ভর্তি জ্বর, চোখ লাল, ঠোঁট ফুলে গেছে–ঠোঁটের কোনায় হাসি চিকমিক করছে। অন্তুর বয়স আট, বয়সের তুলনায় সে খুবই গম্ভীর। শুধু বাবা আশেপাশে থাকলে তার গাম্ভীর্য থাকে না।