আলাপের প্রয়োজন দেখছি না।
আপনি আমার কোম্পানির নামে প্রথম চেক আগামীকাল ব্যাংকে জমা দেবেন। চেকে কত টাকার অংক বসানো আছে সেটা দেখে আমি বুঝতে পারব আপনি আমার কাছে কি চাচ্ছেন। কাজ শুরু হবে আগামীকাল থেকে। এই টাকা যখন শেষ হবে তখন আপনাকে বলব— আপনি আরেকটা চেক দেবেন।
তোমার রেমুনারেশন কী হবে?
জুন মাসের নয় তারিখে পার্ক যেদিন খোলা হবে সেদিন আপনি যদি ইচ্ছা করেন আমাকে রেমুনারেশন দেবেন। ইচ্ছা না করলে দিতে হবে না।
তোমার কোম্পানির নাম, যে ব্যাংকে তোমার একাউন্ট আছে তার নাম এবং একাউন্ট নাম্বারটা পরিষ্কার করে এই কাগজে লিখে দাও।
হাসান লিখল। লিখতে গিয়ে সে লক্ষ্য করল তার হাত কাঁপছে— বড় বড় নিশ্বাস পড়ছে। মনে হচ্ছে অতিরিক্ত উত্তেজনায় জ্বর এসে যাচ্ছে। ইয়াকুব সাহেব বললেন, এখন কি আমরা হেন্ডশেক করতে পারি?
হাসান হাত বাড়িয়ে দিল।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমরা ওয়েটিংরুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমি আমার ক্যাশিয়ারকে বলছি চেক রেড়ি করতে চেক সঙ্গে করে নিয়ে যাও। আমি এক কোটি টাকায় একটা চেক লিখছি।
লীনার কাছে মনে হল— ভূমিকম্প হচ্ছে, ঘরবাড়ি দুলছে। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের পানি সামলাতে চোখের পানি সামলানো মনে হয় কঠিন হবে। কোনো একটা বাথরুমে ঢুকে কল ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলে কেমন হয়? এদের এত সুন্দর অফিস। বাথরুমগুলিও নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে।
টেবিলের উপর পেপার ওয়েটে চাপা দেয়া কাগজে লীনা চায়ের যে নামটা লিখে রেখেছে তার জন্যেও ভয় ভয় লাগছে। বিশ্রী একটা নাম দেয়ার কারণে ইয়াকুব সাহেব তাদেরকে হয়ত রাগ করে কাজই দেবেন না। কায়দা করে কাগজটা সরিয়ে ফেললে হয় না?
লীনা চায়ের নাম লিখেছে ইয়া-চা। মাথায় শেষ মুহূর্তে ইয়াকুব সাহেবের নামটা এসেছে। ইয়াকুব সাহেবের নামের সঙ্গে মিলিয়ে–ইয়া চা। ছি! কি ছেলেমানুষী!
লীনার মা সুলতানা
লীনার মা সুলতানা সন্ধ্যা সাতটা থেকে বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছেন। মেয়ে অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি করছে কেন? এত দেরি তো কখনো হয় না। ঢাকা শহরের অবস্থা ভালো না! ছেলেরাই সন্ধ্যার পর বের হয় না, সেখানে লীনা একটা মেয়ে। বাইশ বছর বয়েসী বাচ্চামেয়ে।
টেনশানে সুলতানার মাথা ধরে গেছে। এখন সামান্য ধরেছে। লীনা আসতে যত দেরি করকে মাথাধরা ততই বাড়তে থাকবে। একসময় ব্যাথাটা মাইগ্রেনে চলে যাবে। তখন দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় ছটফট করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তার মাইগ্রেন জগৎবিখ্যাত। একবার ব্যথা উঠলে তিন-চারদিন থাকে।
সুলতানার ছোটমেয়ে বীনা বারান্দায় এসে মার পাশে দাঁড়ায়। হাসিমুখে বলল, মা তুমি একবার ঘরে যাচ্ছ একবার বারান্দায় আসছ— এই করে মোট একুশ বার ঘর-বারান্দা করে ফেলেছে। আমি বসে বসে শুনলাম।
সুলতানা বললেন, তাতে তোর কী সমস্যা?
বীনা বলল, বিরক্তি লাগছে মা। একই জিনিস কেউ দুবার করলেই আমার বিরক্তি লাগে, তুমি একুশ বার করছ,— বিরক্তি লাগবে না? তারচে একটা কাজ কর— আমি মোড়া এনে দিচ্ছি, তুমি বারান্দায় বসে থাকো।
সুলতানা বললেন, চুলায় গরম পানি দিয়ে রাখ। লীনা এসেই গরম পানিতে গোসল করে। পানিটা রেডি থাকুক।
আপাকে আসতে দাও মা। আগেই গরম পানি কীজন্যে? এমনওতো হতে পারে আপা আসবেই না।
সুলতানা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, আসবে না মানে?
বীনা বলল, ঠাট্টা করলাম মা।
আর কখনো এরকম ঠাট্টা করবি না।
আচ্ছা যাও করব না। একটা বেবিটেক্সি এসে থেমেছে মা। আপার মতো দেখতে একটা মেয়ে নামছে। এই দেখ তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটু হাতটা নাড়োতো মা।
সুলতানার মাথাধরা দূর হয়েছে। তাঁর এই আনন্দ লাগছে যে চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অথচ এত অনিন্দিত হবার কিছু নেই। মেয়ে তো ঘরে ফিরবেই। চাকরি করে যে মেয়ে সে দু-একদিন দেরি করে ফিরবে এটাও তো স্বাভাবিক।
লীনা ধুপধাপ শব্দে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠছে। সুলতানা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গম্ভীর থাকার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। মুখে হাসি এসে যাচ্ছে। ধুপধাপ শব্দটা তাঁর আনন্দ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা সব কাজে এত শান্ত, শুধু সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় দৌড়ে উঠবে। কোনো একদিন পা পিছলে একটা ঘটনা না ঘটায়। মেয়েটাকে ধমক দিতে হবে। আজ না অন্য কোনোদিন।
লীনা ঘরে ঢুকেই বলল, রান্না কী মা?
সুলতানা বললেন, সিমের বিচি দিয়ে শিং মাছ, করলা ভাজি, ডাল। ঘরে বেগুন আছে তুই চাইলে বেগুন ভেজে দেব।
লীনা বলল, সব রান্না নর্দমায় ফেলে দাও তো মা। সব ফেলে দিয়ে হাঁড়ি পাতিল ধুয়ে ফেল।
সুলতানা অবাক হয়ে বললেন, কেন?
আজ বাইরে থেকে খাবার আসবে। স্যার খাবার পাঠাবেন।
সুলতানা বললেন, খাবার পাঠাবেন কেন?
লীনা বলল, আজ আমরা বিরাট এক কাজ পেয়েছি মা। এই উপলক্ষে খাবার আসবে। খুবই রোমাঞ্চকর ঘটনা। গোসল করে এসে তোমাকে বলব। গোসলের পানি কি গরম আছে মা?
সুলতানা লজ্জিত হয়ে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। তাঁর মেয়েটা অফিস থেকে এসেই গরম পানি দিয়ে গোসল করতে চায়। এটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, তার পরেও পানিটা গরম থাকে না। এই দোষটা তার। সুলতানা মনে মনে ঠিক করে ফেললেন— এই ভুল আর হবে না।
লীনা বাথরুমে গোসল করছে।
বাথরুমের দরজা অর্ধেক খোলা। দরজার ওপাশে মোড়া পেতে বীনা বসে আছে। গোসল করতে করতে বীনার সঙ্গে গল্প করা লীনার অনেকদিনের পুরানো অভ্যাস। গল্পগুজবের এই অংশে সুলতানা থাকেন না। কারণ তিনি লক্ষ্য করেছেন তাকে দেখলেই দুই মেয়ে গল্প থামিয়ে দেয়। এতে তিনি খুবই মনে কষ্ট পান। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তাদের ব্যক্তিগত গল্প থাকতেই পারে। যে গল্প মাকে শোনানো যায় না। সুলতানার মন তীতে শান্ত হয় না। দুই বোনের গল্পের এই অংশে তিনি মন খারাপ করে রান্নাঘরে বসে থাকেন।