তোমার কথা সত্যি হলে ধরে নিতে হবে যে আমার কল্পনা করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।
হাসান কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, পরে কোনো এক সময় এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করব। আজ কাজের কথা বলি।
জ্বি বলুন।
আমার একটি মাত্র মেয়ে। সে তার কন্যা নিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকে— ভার্জিনিয়াতে। আমার মেয়ের নাম শামা। শামার কন্যাটির নাম এলেন। এলেনের বয়স পাঁচ আগামী জুন মাসের ৯ তারিখে এলেনের বয়স হবে ছয় বছর।
হাসানের মনে হল— ইয়াকুব সাহেব বৃদ্ধবয়সজনিত সমস্যায় ভুগছেন। বৃদ্ধ বয়সে লোকজন কথা বলতে পছন্দ করে। তাদের অবচেতন মনের কোনো অংশ হয়তো সিগন্যাল পাঠায় সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে— যা কথা বলার তাড়াতাড়ি বলে নাও। বৃদ্ধ তার মেয়ে এবং নাতনীর যে ইতিহাস শুরু করেছে তার সঙ্গে হাসানের কাজের সম্পর্ক কী?
হাসান।
জ্বি স্যার।
জয়দেবপুরের শালবনে আমার দুশ বিঘার মতো জমি আছে। একটা কেমিকেল ইনডাস্ট্রি করার জন্যে জায়গাটা নিয়েছিলাম পরে আর ইন্ডাস্ট্রি করা হয়নি। জায়গাটা পতিত পরে আছে। আমি সেখানে একটা পার্কের মতো করতে চাই— শিশু পার্ক।
পার্কে কী থাকবে?
কী থাকবে সেটা তুমি ঠিক করবে। তোমার রুচি আছে, কল্পনাশক্তি আছে। আমার যেহেতু টাকাপয়সা আছে, তোমার লজিক অনুসারেই রুচি এবং কল্পনাশক্তি থাকার কথা না। আমি তোমার রুচি এবং তোমার কল্পনার উপর ভরসা করছি।
হাসান ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমার কথায় রাগ করবেন না। আপনি পার্ক নিয়ে কী ভাবছেন আমার জানা দরকার।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি কিছুই ভাবছি না। আমি শুধু ভাবছি ছনম্বর জন্মদিন এলেন ঐ পার্কে করবে এবং সে মুগ্ধ হয়ে ভাববে— এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে আছে! সে যেন বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলে মা আমি এখানেই থাকব। আমি স্টেটস-এ ফিরে যাব না। আমি আমার নিম্নমানের কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি— সে নিজের মনে ছোটাছুটি করতে করছে— যাই দেখছে সে বিস্মিত হচ্ছে। সে ছুটে গেল জঙ্গলে সেখানে বিশাল সাইজের ডায়নোসর। এমনভাবে বানানো হয়েছে। যেন ডায়নোসরগুলি কংক্রিটের না, জীবন্তু। বুঝতে পারছ?
জ্বি পারছি।
এলেন মুগ্ধ হয়ে ছুটছে, হঠাৎ দেখল– রূপকথার জগৎ। রূপকথার রাজারানীদের প্রাসাদের মতো প্রাসাদ। এক জায়গায় দেখল— ডাইনীদের আস্তানা। ডাইনীরা বড় ডেগচিতে কী যেন রান্না বসিয়েছে। খুব সম্ভব নরমাংস।
একটা লেক থাকবে। লেকের পানি তুবে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। লেক ভর্তি রঙিন মাছের ঝাঁক। লেকের উপর নৌকা থাকবে। ও আচ্ছা, নকল জলপ্রপাত থাকবে। একটা সুড়ং থাকতে পারে। সুড়ংঙের ভেতর দিয়ে এলেন যখন হাঁটবে, যে নানান বিস্ময়কর ব্যাপার দেখতে দেখতে এগুবে। সুড়ং যেখানে শেষ হবে সেখানে তার জন্যে একটা বিস্ময় অপেক্ষা করছে। বিস্ময়টা কী আমি জানি না। জানতেও চাই না। হাসান, এতবড় দায়িত্ব এককভাবে নেবার মতো সাহস কি তোমার আছে?
হাসান বলল, আছে। আপনার বাজেট কত?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার কত দরকার?
হাসান বলল, কত দরকার আমি বুঝতে আপ্রছি না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি তোমার বানানো পানিতে ডুবে থাকা পরী দেখেছি। তুমি যদি সাহস করে বলো আমি পারব। তাহলে তুমি পারবে। বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
হাসান বলল, কাজ শুরুর সময় সবাই এরকম বলে— বাজেট নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। কাজ কিছুদূর আগাবার পরই বাজেট সমস্যা শুরু হয়।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, শখের কাজে কখনো বাজেট সমস্যা হয় না। শখের বাজেট সব সময় থাকে।
হাসান বলল, শখের একটা সমস্যাও আছে স্যার। শখ বেশিদিন থাকে। আপনি কিছু বোঝার আগেই দেখবেন শখ চলে গেছে।
ইয়াকুব সাহেব আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, হাসান শোনো। প্রতিটি মানুষই আলাদা। সেই হিসেবে একেক জন মানুষের শখের স্থায়িত্ব একেক রকম।
স্যার আপনি পুরো কাজটা করতে চাচ্ছেন— এলেন নামের পাঁচ বছরের একটা মেয়েকে মুগ্ধ করার জন্যে। ধরুন কোনো কারণে মেয়েটি বলল—— সে এবার বাংলাদেশে আসতে পারছে না, পরে কোনো এক সময় আসবে তখনো কি আপনার শখ থাকবে?
এলেন আসবে। কারণ আমি তাকে দেখতে চেয়েছি। আমি অসুস্থ আমি একজন ডাইং পেসেন্ট। ডাক্তাররা বলে দিয়েছেন খুব বেশি হলে আমি দুবছর বাঁচব। এই অবস্থায় এলেন আসবে না তা হয় না। তারপরেও যদি না আসে কোনো ক্ষতি নেই। আমার মুখের কথার দাম অনেক বেশি। আমার সঙ্গে তোমার সেরকম পরিচয় নেই বলেই তুমি দ্বিধায় ভুগছু। ঠিকমত বলো তুমি কি কাজটা করতে পারবে?
পারব— যদি মানি সাম্পাই ঠিক থাকে আমি পারব। কিছুদূর কাজ করার পর টাকার জন্যে হাতগুটিয়ে বসে থাকতে হলে আমি পারব না।
জুন মাসের নয় তারিখে পার্কের গেট খোলা হবে— পারবে?
পারব।
প্রশ্নটা আবার করছি : জুন মাসের নয় তারিখে পার্কের গেট খোলা হবে। পারবে?
পারব।
ভালো। হাত বাড়াও আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক কর।
হাসান বলল, আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার আগে আমার কিছু কথা আছে স্যার।
বলো।
আমি কাজটা আমার মতো করব। সেখানে আপনি কিছু বলতে পারবেন না। আপনি বলতে পারবেন না–এই ডায়নোসরটা এরকম কেন? সাইজে ছোট কেন? কিংবা এই ডায়নোসরটার মুখ বাকা কেন?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, আমি এলেনের সঙ্গে জুন মাসের নয় তারিখেই প্রথম পার্কে যাব।
আমি কোথায় কী করছি এ নিয়ে আপনার সঙ্গে আলাপ করব না।