জ্বি।
কী নাম?
এখন মনে পড়ছে না স্যার।
ইয়াকুব সাহেব তোমার নামটাই পছন্দ করেছেন। তার জন্যে তুমি নিশ্চয়ই বেশ ভালো এমাউন্টের একটা চেক পাবে। নতুন সংসার শুরু করার সময় টাকাটা কাজে লাগবে। কনগ্রাজুলেশনস।
আমি কি এখন চলে যাব স্যার?
হ্যাঁ।
কাউকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হবে না?
না।
কয়েক দিন পরে যাই স্যার? নতুন কেউ আসুক, তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তারপর যাই। এই কদিন আমি তাঁবুর ভেতর থাকব। তবু থেকে বের হব না।
দায়িত্ব বুঝানোর কিছু নেই। তোমাকে এমন কোনো দায়িত্ব দেয়া হয়নি যে আরেকজনকে বুঝাতে হবে। তুমি আজই যাবে।
জি আচ্ছা যাব। আজই যাব।
যাবার আগে ফিরোজ সাহেবকে আমার কাছে পাঠাবে। তার হাতে আমি একটা চিঠি দিয়ে দেব।
জ্বি আচ্ছা।
লীনা উঠে দাঁড়াল। তাঁবুর দরজা পর্যন্ত গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
জিজ্ঞেস কর।
জিজ্ঞেস করতে ভয়-ভয় লাগছে স্যার। আমি আপনাকে প্রচণ্ড ভয় পাই।
ভয় পাবার কিছু নেই। জিজ্ঞেস কর।
অনেক দিন থেকে দেখছি আপনার খুবই মন খারাপ। কেন মন খারাপ স্যার?
হাসান ক্লান্ত গলায় বলল, আমার ছেলেটা অসুস্থ। বেশ অসুস্থ। তার মা একা তাকে নিয়ে ডাক্তারদের কাছে ছোটাছুটি করছে। তার প্রচণ্ড দুঃসময়ে আমি পাশে থাকছি না। এইজন্যেই সারাক্ষণ মনটা খারাপ হয়ে থাকে। লীনা এখন তুমি যাও। আমি কাজ করব। কয়েকটা জরুরি চিঠি লিখতে হবে।
স্যার আপনি একটু সহজভাবে আমার দিকে তাকান। আমি আপাকে খুবই ভয় পাই। আপনি যেভাবে তাকিয়ে আছেন আমার প্রচণ্ড ভয় লাগছে?
লীনা, তুমি যাও তো। এখন তুমি আমাকে বিরক্ত করছ।
হাসানের প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথার ভেতর দপদপ শব্দ হচ্ছে। তার উচিত ব্যথা কমাবার কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা। তবে তারও আগে চিঠিটা লিখে ফেলা দরকার। হাসান কাগজ কলম নিয়ে বসল—
কল্যাণীয়াসু বীনা,
তোমার চিঠিটা পড়লাম। এত সুন্দর করে এত গুছিয়ে এর আগে আমাকে কেউ চিঠি লিখেছে বলে আমার মনে পড়ে না। তোমার কথামতো তোমার অতিপ্রিয় বোনকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিলাম। কাজটি করার জন্যে আমাকে রূঢ় আচরণ করতে হয়েছে। আমি বিষণ্ণ বোধ করছি। মানুষের সঙ্গে রূঢ় আচরণ করে আমি অভ্যস্ত না। এই আচরণ লীনার প্রাপ্য ছিল না।
আমি তোমার বোন এবং ফিরোজ সাহেবকে বিয়ে উপলক্ষে একটা গিফট দিতে চাই। আমি চাই না এরা কেউ জানুক গিফটটা কে দিয়েছে। তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে। এই ব্যবস্থাটা তুমি অবশ্যই করতে পারবে।
গিফটটা কী তা বলার আগে ছোট্ট একটা গল্প বলে নেই। আমি যখন বিয়ে করি তখন আমার হাতে কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তারপরেও সাহস করে দুজনের জন্যে ঢাকা–কাঠমুণ্ডুর দুটা রিটার্ন টিকেট কিনে ফেলি। যেন আমাদের দুজনের জীবনের শুরুটা হয় বিশাল হিমালয়ের পাশে। শেষপর্যন্ত আমাদের নেপাল যাওয়া হয়নি। টাকাপয়সার এমন ঝামেলায় পড়লাম যে বলার না। বাড়িওয়ালা তিন মাসের ভাড়া পায়। ভাড়া না দিলে উচ্ছেদ করে দেবে এই অবস্থা। টিকিট ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে এলাম। এরপর জীবনে অনেক অর্থ উপার্জন করেছি। পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি। কিন্তু রাগ করে হাতের কাছেই কাঠমুণ্ডু সেখানে যাই নি। আমি লীনা এবং তার বরকে কাঠমুণ্ডুর দুটা টিকিট, সেখানের সবচে ভালো হোটেলে সাতদিন থাকার ব্যবস্থা করে দিতে চাই। তোমার চিঠি পড়ে মনে হল আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা ভালো না। হয়তো তোমার ধারণা ঠিক। আমি নিজে যে নিজেকে সবসময় বুঝি তা না। তারপরেও বলব মায়ানগর সম্পূর্ণ হলে একবার এসে দেখে যেও। আমার মন বলছে মায়াগর দেখার পরে তুমি বলবে—লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম এত খারাপ তো সে না।
বীনা শোনো, যার ভেতর অন্ধকার থাকে সে আলো নিয়ে খেলতে পারে না। আমি সারাজীবন আলো নিয়েই খেলেছি। তারপরেও আমার ভুল হতে পারে। হয়তো তারাই আলো নিয়ে খেলে যাদের হৃদয়ে গভীর অন্ধকার।
তুমি ভালো থেকো। তোমার চিঠি খুব ভালো হয়েছে। এটা আবারো না বলে পারছি না।
হাসানুল করিম
ডাকে মাদ্রাজ থেকে নাজমার চিঠি
ডাকে মাদ্রাজ থেকে নাজমার চিঠি এসেছে। সংক্ষিপ্ত চিঠি। নাজমা লিখেছে—
প্রিয় অন্তুর বাবা,
সুসংবাদ দিয়ে শুরু করছি। এখানকার ডাক্তাররা অন্তুর অসুখ প্রায় সারিয়ে ফেলেছেন এটা বলা যায়। তার পায়ের ফোলা, মুখের ফোলা কমেছে। একটা কিডনি ফিফটি পারসেন্ট কাজ করতে শুরু করেছে। গতকাল তাকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্যে ঘুরতে বের হয়েছিলাম–সে ভূতের ভিডিও ক্যাসেট কিনবে এবং তোমাকে নিয়ে দেখবে। দোকানদারকে সে বেশ গুছানো ইংরেজিতে বলেছে— ভূতের ছবি দিন। তবে সেই ছবিতে মাকড়সা থাকলে চলবে না। আমার বাবা আবার মাকড়সা খুব বেশি ভয় পায়।
শুধু-যে ভূতের সিডি কেনা হয়েছে তা না, সে যাই দেখছে বলছে–বাবার জন্যে কিনব। তার যন্ত্রণায় এ পর্যন্ত তোমার জন্যে যেসব জিনিস কেনা হয়েছে তা হল–
একজোড়া স্পঞ্জের গাবদা স্যান্ডেল।
একটা লিটল মারমেইডের ছবি আঁকা তোয়ালে।
নীল রঙের নাইলনের ফিতা। এই ফিতাটা নাকি তোমার খুব কাজে লাগবে।
আচ্ছা শোন, কিছু কিছু মানুষকে তুমি কী জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ কর বল তো। তোমার কাছ থেকে আমাকে কৌশলটা শিখতে হবে। আমি পুত্র-কন্যা-স্বামী কাউকেই মুগ্ধ করতে পারিনি।
তোমার মায়ানগরের কাজ আশা করি খুব ভালো হচ্ছে। ঠিক সময়ে শেষ হবে? দিন তো ঘনিয়ে এল।