তোমার নাম হাসান? কেমন আছ?
হাসান বলল, ভালো।
ইয়াকুব সাহেব লীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়ে! তোমার নাম কী?
লীনা বলল, স্যার আমার নাম লীনা।
তুমি কেমন আছ?
ভালো আছি।
ইয়াকুব সাহেব হঠাৎ খুব ব্যস্ত ভঙ্গিতে ড্রয়ার খুললেন। মনে হচ্ছে জরুরি কোনো কিছু তার হঠাৎ মনে পড়েছে। জরুরী ব্যাপারটা শেষ করে কথা শুরু করবেন। ইয়াকুব সাহেব ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ বের করতে করতে বললেন, তোমাদের সঙ্গে মোবাইল টেলিফোন নেই তো। যদি থাকে অফ করে রাখো। আমার জটিল কোনো সমস্যা হয়েছে, মোবাইল টেলিফোনের রিঙের শব্দে চট করে মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়। নরম্যাল টেলিফোনে হয় না। আমার ধারণা সমস্যাটা মানসিক।
লীনা বলল, স্যার আমাদের সঙ্গে মোবাইল টেলিফোন নেই।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, নেই কেন? তোমাদের এতবড় ফার্ম।
হাসান বলল, স্যার আমাদের ফার্ম বড় না, খুব ছোট।
ইয়াকুব সাহেব হাসানের দিকে ঘুরে বসে আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন— কত ছোট? তোমাদের অফিসে লোক কত জন?
হাসান বলল, সব মিলিয়ে চারজন ছিল। একজনের চাকরি চলে গেছে— এখন তিনজন। আমি লীনা এবং একজন অফিস পিওন।
কার চাকরি চলে গেল?
হাদিউজ্জামান বলে একজন ছিল—ম্যানেজার।
চাকরি কেন গেল? টাকাপয়সার হিসেবে গণ্ডগোল করেছে?
অনেকটা সেরকমই।
তিনজনে অফিস চালাতে পারছ?
জি পারছি। আমরা যখন কাজ পাই, তখন লোক ভাড়া করি।
তোমরা কি আমার বাগানের চা খেয়েছ?
লীনা বলল, জ্বি স্যার।
চায়ে গন্ধ কেমন?
সুন্দর গন্ধ।
ইয়াকুব সাহেব আবারো টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। লীনার কাছে মনে হল তিনি একটা ঘড়ি বের করেছেন। এই ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। কিংবা একটু পর পর ড্রয়ার খোলা হয়ত তাঁর অভ্যাস। বড় মানুষদের অনেক বিচিত্র অভ্যাস থাকে।
ইয়াকুব সাহেব লীনার দিকে তাকিয়ে বললেন–আমার হাতে যে জিনিসটা দেখছ এর নাম স্টপওয়াচ। আমি তোমাকে এক মিনিট সময় দিলাম। এই এক মিনিটের ভেতর তুমি আমার বাগানের চায়ের একটা নাম দেবে। আমি বাগানের চা মার্কেটিং করব। চায়ের নাম খুঁজছি। তুমি মনে করো না যে তোমাকেই শুধু নাম জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। যারা আমার বাগানের চা খেয়েছে তাদের প্রায় সবাইকেই এই প্রশ্ন করেছি। এক মিনিট সময় দিয়েছি। তাদের সবার নামই লেখা আছে। যার নাম শেষপর্যন্ত ঠিক করা হবে তার জন্যে পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে।
লীনা ভীত গলায় বলল, আমার মাথায় কোনো নাম আসছে না স্যার।
ইয়াকুব সাহেব প্যাডের একটা কাগজ ছিড়ে লীনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন— এই কাগজে তোমার নাম ঠিকানা লেখ। এখন আমি স্টপওয়াচ চালু করছি। তুমি এত নার্ভাস হচ্ছ কেন? তুমি তো পরীক্ষা দিতে বস নি। টপটপ করে ঘাম পড়ছে। আশ্চর্য তো!
লীনার হাত পা কাঁপছে। কী কাণ্ড! হঠাৎ সে এমন ঝামেলায় পড়বে কে জানত। চায়ের নাম কিছু-একটা তো লিখতে হবে। সে কী লিখবে। এই মুহূর্তে তার মাথায় একটা নামই ঘুরছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বইএর নাম সঞ্চয়িতা। সে নিশ্চয়ই চায়ের নাম সঞ্চয়িতা রাখতে পারে না। টিভিতে এড় যাবে সঞ্চয়িতা চা খান। এ ধরনের কোনো নাম কাগজে লিখলে ইয়াকুব নামের মানুষটা বিরক্ত হবেন। তিনি হয়তো ভাববেন লীনা তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। অথচ সে ঠাট্টা করছে না। সে কারো সঙ্গেই ঠাট্টা করতে পারে না। আশ্চর্য আল্লাহ তাকে এমন গাধার মতো মগজ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কেন? সঞ্চয়িতা ছাড়া আর কোনো নাম কেন তার মাথায় আসছে না?
ইয়াকুব সাহেব বললেন, সময় শেষ। নামটা কাগজে লিখে পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা দাও। এসো এখন কাজের কথা শুরু করা যাক।
ইয়াকুব সাহেব আবারো ড্রয়ারে হাত দিলেন। ড্রয়ার থেকে খুব সুন্দর কাজ করা কাঠের বাক্স বের করলেন। বাক্স খুলে সিগারেট বের করে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে বাক্স হাসানের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, সিগারেটের নিকোটিনে শরীর অভ্যস্ত থাকলে সিগারেট ধরাও। জটিল আলোচনার সময় নিকোটিনের সাপ্লাইয়ের তোমার প্রয়োজন হতেও পারে। বয়সজনিত কারণে আমাকে সমীহ করার কোনো কারণ নেই।
হাসান সিগারেট ধরাল। ইয়াকুব সাহেব চেয়ারে হেলান দিতে দিতে বললেন, আমি তোমার একটা কাজ দেখেছি।
হাসান বলল, কোন কাজটা দেখেছেন?
জুমলা সাহেবের বাগানবাড়ির সামনে তুমি একটা ওয়াটার-বড়ি তৈরি করেছ। সেখানে একটা পরীর মূর্তি আছে। মূর্তিটা পানিতে ডুবে আছে, শুধু তার চোখ দেখা যাচ্ছে। আমি এই কাজটা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
হাসান বলল, থ্যাংক য়্যু স্যার।
তুমি ঐ কাজটা শেষ করনি কেন?
জুমলা সাহবের সঙ্গে আমার মতের মিল হল না। উনি বললেন, মূর্তি যদি পানিতে ডুবেই থাকে তাহলে এতটাকা খরচ করে মূর্তি বানানো হল কেন?
আমি ওয়াটার-বড়িতে জলপদ্মের ব্যবস্থা করেছিলাম, উনি চাইলেন বিদেশী বড় বড় পাতার কী যেন গাছ। আমি বললাম, কাজ করব না। উনি আমার সব পেমেন্ট আটকে দিলেন।
হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনাদের মতো বড়মানুষদের সঙ্গে কাজ করার একটা প্রধান সমস্যা হল–আপনাদের অর্থ আছে, কিন্তু রুচি নেই। আপনারা নিজের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, কিন্তু যাকে কাজ দিচ্ছেন তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, তোমার ধারণা তোমার রুচি খুব উন্নত?
হাসান বলল, আমার কল্পনার ক্ষমতা ভালো। বিত্তবান মানুষরা কল্পনা করতে পারেন না। তারা বাস্তব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে কল্পনা করার সময় পান না। কল্পনা না করতে করতে কল্পনা করার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়। তারা যখন কোন পরী কল্পনা করেন তখন আকাশে পরী উড়ছে এই কল্পনাই করেন। একটা পরীযে পানিতে ডুব দিয়েও থাকতে পারে এই কল্পনা করতে পারেন না।