হোসেন তাকিয়ে আছে। মনে হল তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। ফিরোজ বলল, সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সংসারে একটা জিনিস আছে যা কেউ চায় না। পিতা চায় না, মাতা চায় না, পুত্র-কন্যা চায় না। না চাইলেও সবাইকে সেই জিনিস গ্রহণ করতে হয়। কেউ বাদ যায় না।
বলতে পারব না।
ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা যাও। বলতে না পারলে কী আর করা।
ফিরোজ অন্ধকারে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। তার মাথায় আরো ধাঁধা আসছে। লীনা যখন ছোট ছিল-সেভেন এইটে পড়ত, তখন ফিরোজ তাকে ধাঁধা জিজ্ঞেস করত। লীনা প্রাণপণ চেষ্টা করত ধাঁধার জবাব দিতে। যখন দিতে পারত না তখন কেঁদে ফেলত। নিঃশব্দ কান্না না, ভেউ ভেউ করে বাড়িঘর ঝাঁপিয়ে কান্না। লীনার বড়ভাই সাব্বির ফিরোজের উপর রাগ করত। বিরক্তগলায় বলত, তুই সবসময় ওকে কাঁদাস কেন? জানিস ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে সে কাঁদে। জেনেশুনে কঠিন কঠিন ধাঁধা।
ফিরোজ বলত, ধাঁধার জবাব দিতে না পারলে কাঁদবে কেন?
লীনা অন্য সবার মতো না। নরম স্বভাবের মেয়ে। এটা মাথায় রাখবি। যেসব ধাঁধার জবাব সে জানে সেসব জিজ্ঞেস করবি। দেখবি জবাব দিয়ে সে কত খুশি হয়। মানুষকে খুশি করার মধ্যে কি কোনো দোষ আছে?
না, দোষ নেই।
কথা দে, তুই কখনো লীনাকে কঠিন কোনো ধাঁধা জিজ্ঞেস করবি না।
আচ্ছা যা কথা দিলাম।
মনে থাকে যেন।
মনে থাকবে।
ফিরোজের মনে আছে। লীনাকে সে কখনোই কোনো কঠিন ধাঁধা জিজ্ঞেস করেনি। সমস্যা হচ্ছে যে মেয়ে কঠিন ধাঁধা পছন্দ করে না, সে নিজে ঝাপ দিয়ে কঠিন এক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেছে। এই ধাঁধার জবাব ফিরোজ ইচ্ছা করলে দিয়ে দিতে পারে। দেয়া ঠিক হবে না। কিছু কিছু ধাঁধার জবাব নিজেকে খুঁজে বের করতে হয়। এমনও হয় যে, খুব সহজ ধাঁধা কিন্তু জবাব খুঁজতে এক জীবন চলে যায়।
লীনা হাসানের সামনে বসে আছে।
হাসান কাপে কফি ঢালছে। এই কাজটা করা উচিত লীনার, কিন্তু সে করতে পারছে না। স্যার কফির পট হাতে নিয়ে নিয়ে কফি ঢালা শুরু করেছেন। সে তো এখন কেড়ে স্যারের হাত থেকে কফিপট নিয়ে নিতে পারে না। লীনা খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
লীনা কেমন আছ বলো।
লীনা নড়েচড়ে বসল। কী অদ্ভুত প্রশ্ন! আজ সারাদিন তো সে স্যারের সঙ্গেই ছিল। ডায়নোসরে কীভাবে রঙ করা হয় দেখছিল। তাঁবুতে সে স্যারের সঙ্গেই এসেছে। স্যার বললেন, আমার সঙ্গে এসো তো লীনা। কিছুক্ষণ তোমার সঙ্গে কথা বলি।
তখন থেকেই লীনার বুক ধ্বক ধ্বক করছে। স্যার তার সাথে কি কথা বলবেন? সে ভেবে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছে না। এখন বললেন, লীনা কেমন আছ বলো। লীনা কি বলবে সে ভালো আছে? নাকি চুপ করে থাকবে।
কফি খেতে কেমন হয়েছে লীনা?
ভালো হয়েছে স্যার।
ফিরোজ সাহেব যে এসেছিলেন, উনি কি চলে গেছেন?
পাঁচটার সময় চলে যাবার কথা, হয়তো চলে গেছেন। আমি খোঁজ নিইনি।
হাসান বলল, উনি যাননি। আমি খোঁজ নিয়েছি।
লীনা বলল, তাহলে স্যার উনি রাত দশটায় যাবেন।
হাসান বলল, একটা কাজ কর। তুমি তার সঙ্গে চলে যাও।
লীনা হতভম্ব গলায় বলল, আমি কোথায় যাব?
তোমার মার কাছে যাবে। সামনের মাসে তোমার বিয়ে। জঙ্গলে পড়ে থাকলে তো হবে না। বিয়ের আগে আগে কত কাজকর্ম আছে।
এখানে এতকিছু হচ্ছে, সব ফেলে আমি বাসায় চলে যাব?
হ্যাঁ যাবে। যে কাজকর্ম এখানে হচ্ছে তাতে তুমি তেমন কোনো সাহায্য করতে পারছ না। তোমাকে বেতনের স্টেটমেন্ট তৈরি করতে বলেছিলাম, সেটা কি করেছ? আমি লক্ষ্য করছি এখানে তোমার প্রধান কাজ হচ্ছে সেজেগুজে ঘুরে বেড়ানো। গত পরশু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তুমি সূর্যঘরে বসেছিলে। তাই না?
জি স্যার।
কেন বসেছিলে?
লীনা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, আমরা এত সুন্দর সুন্দর জিনিস বানাচ্ছি, এসব দেখতে আমার ভালো লাগে।
হাসান কঠিন গলায় বলল, হোসেনের কাছে শুনেছি সপ্তাহখানিক আগে রাত একটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত তুমি আমার তাঁবুর সামনে রাখা বেঞ্চটায় বসেছিলে। এটা কি সত্যি?
জি স্যার।
কেন বসেছিলে?
কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ শেষরাতে উঠে। চাঁদ দেখার জন্যে বসেছিলাম।
তোমার ভাবুর সামনে বসে চাঁদ দেখা যায় না?
যায় স্যার।
তাহলে আমার ভাবুর সামনে বসে ছিলে কেন?
লীনা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, স্যার আমি আর কোনোদিন বসব না।
হাসান বলল, লীনা কাঁদবে না। তরুণী এক মেয়ে বাচ্চাদের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদছে— দেখতে ভালো লাগে না। কান্না বন্ধ কর।
কান্না বন্ধ করতে প্রাণপণ চেষ্টা লীনা করছে। পারছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। স্যার তার উপর রাগ করেছেন— এরচে মরে যাওয়া ভালো ছিল। ক্রেন দিয়ে বড় বড় স্ল্যাভ যখন নামাচ্ছিল তখন সে কেন দৌড়ে কোনো একটা স্লাভের নিচে দাঁড়াল না!
লীনা শশানো, তুমি এখানে তেমন কোনো কাজ করতে পারছ না। দীর্ঘদিন তুমি এখানে আছ, এটা খুবই সত্যি। একদিনের জন্যেও ছুটি নিয়ে ঢাকায় যাওনি তাও সত্যি। আমার কোনো কাজকর্মও যে এখানে করছ না ঢাকায় যাওনি তাও সত্যি। আবার কোনো কাজকর্মও যে এখানে করছ না তাও সত্যি। তুমি কি বুঝতে পারছ?
পারছি স্যার।
কাজেই তুমি ঢাকায় চলে যাও। মার সঙ্গে থাকো। বিশ্রাম কর। বিয়ের সময় কনের উপর দিয়ে অনেক মানসিক চাপ যায়। কাজেই বিয়ের কনের বিশ্রাম দরকার।
বিয়ের পর আমি কি আবার এসে কাজ শুরু করব?
না। বিয়ের পর জঙ্গলে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। স্বামীর সঙ্গে থাকবে। আসল কথা বলতে ভুলে গেছি–তুমি কি ইয়াকুব সাহেবের চা-এর কোনো নাম দিয়েছিলে?