বলতে ইচ্ছা করলে বলো। কোনো সমস্যা নেই।
তুমি একটু সহজ হও তো। তোমার সঙ্গে দেখি হালকা ঠাট্টা-তামাশাও করা যায় না। এখন বলো সামনের মাসের একুশ তারিখে তোমার কি কোনো প্রগ্রাম আছে? বিয়েতে কনে উপস্থিত না থাকলে তো সমস্যা। অবশ্যি মোবাইল টেলিফোন আছে। কবুল কবুল মোবাইল টেলিফোনেও বলতে পারবে।
লীনা বলল, এই প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যেতে পারব না।
প্রজেক্ট শেষ হবে কবে?
জুন মাসের আট তারিখে। জুন মাসের নয় তারিখে ওপেনিং।
জুন মাসের আট তারিখ পর্যন্ত তোমাকে এখানে খুঁটি গেড়ে বসে থাকতে হবে?
হ্যাঁ। আট না, নয় তারিখ পর্যন্ত। ওপেনিঙে আমি থাকব।
তোমার স্যার একদিনের জন্যেও ছুটি দেবেন না?
চাইলে দেবেন। কিন্তু আমি ছুটি নেব না।
কেন?
প্রজেক্ট চলাকালীন সময়ে আমি বিয়ের ঝামেলায় যাব না।
বিয়েটাকে তোমার এখন ঝামেলার মতো মনে হচ্ছে?
তোমার সঙ্গে আমি কূটতর্কে যেতে চাচ্ছি না। এখানে সবাই রাতদিন পরিশ্রম করছে আর আমি বিয়ে করে শাড়ি গয়না পরে বউ সেজে বসে থাকব, তা কেমন করে হয়?
হয় না তাই না?
না, হয় না।
ফিরোজ নাশতা শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। তুমি যেমন কঠিনচোখে তাকিয়ে আছ, বলার সাহস পাচ্ছি না। চোখের দৃষ্টি একটু নরম কর— আমি নতুন একটা প্ল্যানের কথা বলি।
লীনা চুপ করে রইল। কেন জানি হঠাৎ তার প্রচণ্ড রাগ লাগছে। সামনে বসে-থাকা মানুষটাকে অসহ্য বোধ হচ্ছে। নিজের উপর রাগ লাগছে। সে সব কাজকর্ম ফেলে তাঁবুতে বসে মজা করে গল্প করছে। তার উচিত সাইটে চলে যাওয়া।
ফিরোজ বলল, আমার বুদ্ধিটা হচ্ছে–চলো আমরা দুজন একসঙ্গে তোমার স্যারের কাছে যাই। তাঁকে বলি— হে মহামান্য গুরুদেব। আপনি আমাদের দুজনের প্রতি সামান্য দয়া করুন। একটা কাজি খবর দিয়ে এখানে নিয়ে আসুন। আমরা বিয়ে করে ফেলি। এটা একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। প্রজেক্টের লোকজন এতই ব্যস্ত যে বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটা তাদের সাইটে করতে হচ্ছে।
তোমার শস্তা ধরনের রসিকতার কথা শুনতে আমার ভালো লাগছে। আমি এখন কাজে যাব।
আমি কী করব?
তুমি বিশ্রাম করতে চাইলে বিশ্রাম কর। ঘুরে দেখতে চাইলে ঘুরে দেখ।
তুমি কি সত্যি আমাকে রেখে চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ যাচ্ছি।
একুশ তারিখে আমি তাহলে বিয়েটা করতে পারছি না?
না।
তোমাকে একটা আংটি দিয়েছিলাম। আংটিটা দেখছি না। ফেলে দিয়েছ নাকি?
হীরার আংটি ফেলে দেব কেন? কী বলছ তুমি! আংটি পরে কাজ করতে অসুবিধা হয়। এইজন্যে খুলে রেখেছি।
তোমাদের এখানে কি দুপুরের দিকে কোনো গাড়ি যায়?
না।
দুপুরে গাড়ি গেলে দুপুরে চলে যেতাম।
দুপুরে কোনো গাড়ি যায় না।
শেষ গাড়িটা ঢাকায় কখন যায়?
রাত দশটায়।
তাহলে একটা কাজ করি, রাত দশটার গাড়িতেই যাই। এই সময়ে তোমার যদি মন বদলায় সেটাও দেখে যাই! এমনও তো হতে পারে রাত দশটার সময় তুমি ঠিক করলে আমার সঙ্গে চলে যাবে। তখন তোমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম।
লীনা বলল, আমি যাচ্ছি। কোনো কিছুর দরকার হলে হোসেনকে বলবে। ও ব্যবস্থা করবে।
ফিরোজ বলল, তোমাদের এখানে নাপিত আছে? সময়ের অভাবে সেলুনে গিয়ে চুল কাটাতে পারছি না। এখন যখন কিছু ফ্রি টাইম পাওয়া গেছে-~~ ফ্রি টাইমটা কাজে লাগাই। হেয়ার কাট পাস মাখা ম্যাসাজ। নাপিত আছে?
লীনা বলল, নাপিত নেই। তবে হোসেনকে বললে সে খবর দিয়ে নিয়ে আসবে।
ফিরোজ বলল, তুমি হোসেনকে বলে যাও আমার সঙ্গে যেন দেখা করে।
নাপিত খবর দিয়ে আনার জন্যে ফিরোজের হোসেনকে দরকার নেই। হোসেনকে দিয়ে সে স্যারের কাছে বীনার চিঠিটা পাঠাবে। তার মনে ক্ষীণ আশা ছিল বীনার চিঠির প্রয়োজন পড়বে না।
কী লেখা বীনার চিঠিতে? জানতে ইচ্ছা করছে, আবার জানতে ইচ্ছাও করছে না। হোসেনের হাতে চিঠিটা পাঠানো কি ঠিক হবে? সবচে ভালো হত সে নিজে যদি চিঠিটা নিয়ে যেত। সেটাও সম্ভব না।
ফিরোজ পুরোদিন একা কাটাল। লীনা দুপুরে খেতে এল না। সে নাকি সাইটে খাবে। হোসেন আলি তাঁবুর ভেতর ফিরোজের খাবার দিয়ে গেল। ফিরোজ বলল, হোসেন–চিঠি দিয়েছিলে?
হোসেন বলল, জ্বি।
ফিরোজ বলল, স্যার কি চিঠিটা পড়েছেন?
জানিনা। আমি উনার হাতে চিঠি দিয়া চইল্যা আসছি।
লীনার জন্যে তার মা একবাটি তরকারি পাঠিয়েছিলেন। তরকারিটা গরম করে লীনাকে দিতে হবে।
জ্বি আচ্ছা।
দুপুরের খাওয়ার শেষে ফিরোজ ঘুমুতে গেল। চারদিকের হৈহল্লার মধ্যে ঘুমানো মুশকিল। তবে দীর্ঘ সময় শব্দের ভেতরে বাস করছে বলে শব্দ এখন আর কানে লাগছে না। সে কোথায় যেন পড়েছিল— পরিপূর্ণ নিস্তব্ধতায় ঘুম ভালো হয় না।
ফিরোজ ঘুমাল মরার মতো। যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা। তাঁবুর ভেতর অন্ধকার হয়ে আছে। হোসেন আলি টি-পটে করে চা নিয়ে এসেছে।
হোসেন বিনীত গলায় বলল, এর আগেও দুইবার আসছি। ঘুমে ছিলেন, ডাক দেই নাই।
ফিরোজ বলল, ভালো করেছ। লীনা সাইট থেকে এখনো ফিরে নি?
হোসেন বলল, জি ফিরছেন। স্যারের তাঁবুতে আছেন। চা খাইতেছেন।
আমার এখানে কি এসেছিল?
বলতে পারি না।
বিকেল পাঁচটার গাড়ি কি চলে গিয়েছে?
অনেক আগে গেছে। অখন বাজে ছয়টা।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফিরোজ হালকা গলায় বলল, আচ্ছা দেখি তো হোসেন মিয়া—তোমার কেমন বুদ্ধি—এই ধাঁধার উত্তর কি হবে বল।
সংসারে এমন জিনিস কিবা আছে বল
লইতে না চাহে তারে মানব সকল।
কিন্তু তাহা সবে পাবে অতি আশ্চর্য,
বল দেখি বুঝি তব বুদ্ধির তাৎপর্য!