অন্তু চোখ বন্ধ করেই হ্যা-সূচক মাথা নাড়ল।
হাসান বলল, কখন ঘুম ভাঙল?
অন্তু বলল, তুমি যখন ঘরে ঢুকেছু তখনই ঘুম ভেঙেছে।
ডাকিসনি কেন?
ইচ্ছা করেনি।
অসুখ বাধিয়েছিস কেন?
জানি না।
ঘরে কোনো ভালো মুভি আছে? ভিসিআরে ভালো কোনো মুভি দেখতে ইচ্ছা করছে। কার্টুন ফান্টুন না, সিরিয়াস ভূতের ছবি। কফিন থেকে ভূত উঠে আসছে–এই টাইপ। আছে?
ঘোস্ট স্টরি আছে। কিন্তু বাবা তুমি ভয় পাবে।
বেশি ভয়ের নাকি?
খুবই ভয়ের।
তাহলে এক কাজ করি, চাদরের নিচে শরীরটা ঢেকে শুধু মাথা বের করে দেখি। ভয় লাগলে চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলব। বুদ্ধিটা কেমন?
বুদ্ধিটা খুবই ভালো।
তাহলে উঠে আয়–ছবি দেখব।
মা বকবে না তো বাবা?
সেই সম্ভাবনা তো আছেই। তারপরেও রিস্ক নিতে হবে। ভালো কথা অন্তু, তোর একটা দাওয়াত আছে।
কিসের দাওয়াত।
মায়ানগরে ঢোকার নিমন্ত্রণ। তুই ঢুকবি আর এক বিদেশী মেয়ে ঢুকবে। মেয়েটার নাম এলেন। তোর বয়েসী। দেখিস আবার যেন মেয়েটার সঙ্গে প্রেম না হয়ে যায়।
ধ্যাৎ বাবা! তুমি সবসময় এত অসভ্য কথা কেন বলো। আমি প্রেমও করব না, বিয়েও করব না।
তুই না করলে কী হবে। মেয়েরা তো করতে চাইবে।
বাবা অসভ্য কথা বলবে না। আমি কিন্তু রাগ করছি।
হাসন চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছে। চাদরের ভেতর হাসানের সঙ্গে গুটিসুটি মেরে বসেছে অন্তু। ভিসিআরে ভূতের ছবি চলছে।
নাজমা দৃশ্যটা দেখেও কিছু বলল না। তার মন অসম্ভব খারাপ। হাসানকে সে এখনো জানায়নি যে অন্তুকে ডায়ালাইসিস করাতে হয়েছে। নাজমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। তারও ইচ্ছা করছে চাদরের নিচে ছেলের পাশে বসে ছবি দেখতে ইচ্ছাটাকে সে আমল দিল না। নাজমা জানে অন্তর একটি ভুবন আছে শুধুই তার বাবাকে নিয়ে। সেই ভূবনে নাজমার প্রবেশাধিকার নেই।
সুলতানার দাঁতে ব্যথা
সুলতানার দাঁতে ব্যথা।
দাঁতে কোনো ক্যারিজ নেই, কোনো দাত নড়ছেও না, তারপরেও তীব্র ব্যথা। গাল ফুলে গেছে। ব্যথায় তিনি কথা পর্যন্ত বলতে পারছেন না।
বীনা বলল, মা তুমি রিকশা করে কোনো একজন ডেনটিস্টের কাছে চলে যাও। আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু আমার বের হওয়া মানে তিনঘণ্টা সময় নষ্ট। তিন ঘণ্টায় আমি অপটিক্সের একটা চ্যাপ্টার শেষ করতে পারি।
সুলতানা বললেন, তোকে যেতে হবে না। তুই পড়া শেষ কর।
বীনা বলল, মা তুমি রাগ করলে নাকি?
না।
তোমার গলার স্বর কেমন রাগী-রাগী মনে হয়েছে।
সুলতানা বললেন, এত কথা বলিসনা তো বীনা।
বীনা বলল, তুমি শুধু-যে রাগ করেছ তা না— তোমার মনটাও খারাপ হয়েছে। তুমি মনে মনে ভাবছ লীনা কাছে থাকলে আমাকে কখনো বলত না একা একা ডাক্তারের কাছে যেতে। সে অবশ্যই আমার সঙ্গে যেত। মা তুমি এ রকম ভাবছ না?
না আমি এরকম ভাবছি না।
অবশ্যই তুমি এরকম ভাবচ্ছ। কারণ মানুষের স্বভাবই হল তুলনা করা। মানুষ তুলনা করবেই। আচ্ছা মা শোনো, এসো সন্ধা ছটা পর্যন্ত দেখি। আমার ধারণা ফিরোজভাই এর মধ্যে চলে আসবে। যদি না আসে আমি নিয়ে যাব।
আমাকে তোদের কারোরই ডাক্তারের কাছে নিতে হবে না। দরকার মনে করলে আমি নিজেই যাব।
খুবই ভালো কথা মা। তাহলে একটা কাজ কর। রান্নাঘরে যাও। গরম পানি কর, যাতে গরম পানিতে লবণ দিয়ে তুমি গার্গল করতে পার। এইসঙ্গে গরমপানিতে খানিকটা চা-পাতা দিয়ে আমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে এসো।
সুলতানা মেয়ের পাশ থেকে উঠে এসে রান্নাঘরে ঢুকলেন। দাঁতে ব্যথা ছাড়াও তাঁর মনটা খুব অস্থির হয়ে আছে। গত সপ্তাহে বড়মেয়ের কোনো চিঠি পাননি। প্রতি সপ্তাহেই তিনি দুটা করে চিঠি পান। গত সপ্তাহে একটা চিঠিও আসল না–এটা কেমন কথা। আজ দুপুরে বিছানায় শুয়েছিলেন, তন্দ্রামতো এসেছে— এর মধ্যে লীনাকে স্বপ্নে দেখেছেন। লীনার মুখভর্তি বসন্তের দাগ। একটা চোখ বসন্তরোগে নষ্ট হয়ে গেছে। ঠোঁট, জিভ সব কুচকুচে কালো।
স্বপ্নে তিনি আঁৎকে উঠে বলেছেন— কে কে? কুৎসিত মেয়েটা বলেছে— মা আমাকে চিনতে পারছ না? আমি তোমার বড়মেয়ে। আমার নাম লীনা। বসন্তরোগে আমার চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে মা। তবে এতে আমার খুব ক্ষতি হয়নি। আমি ভিক্ষা করি তো। চেহারা কুৎসিত হয়ে যাওয়ায় ভিক্ষা বেশি পাই। দেখ আমার সারাদিনের রোজগার।
এই বলেই লীনা তার থালা উল্টে দিল। ঝনঝন শব্দে থালা থেকে নানান ধরনের মুদ্রা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
এরকম কুৎসিত স্বপ্নের কোনো মানে আছে? সুলতানা বীনার কাছে গিয়েছিলেন স্বপ্নের কথা বলতে। শেষপর্যন্ত বলেননি। বললে বীনা নানান ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে প্রমাণ করে দিত— তিনি খুব স্বাভাবিক স্বপ্ন দেখেছেন। এই স্বপ্ন দেখে অস্থির হবার কিছু নেই। মুরগি সদকা দেবার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।
সবসময় যুক্তিতর্ক শুনতে ভালো লাগে না।
সুলতানা রান্নাঘরে চুলার পাশে বসে আছেন। বড়মেয়ের জন্যে তাঁর খুব মন কাঁদছে। লীনা পাশে থাকলে কোনো অবস্থাতেই তিনি রান্নাঘরে আগুনের পাশে বসতে পারতেন না। তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হত। মেয়ে তারচেয়েও অনেক অস্থির বোধ করত।
সুলতানার ইচ্ছা করছে মেয়ে যেখানে কাজ করছে সেখানে চলে যেতে। মেয়েকে দেখে এলেন। সম্ভব হলে মেয়েকে নিয়ে চলে এলেন। তাকে নিয়ে যাবে কে? ফিরোজকে বললে সে অবশ্যই নিয়ে যাবে। তিনি ঠিক করে রেখেছেন আজ যদি ফিরোজ আসে তাহলে তো ভালই–আজ যদি সে না আসে তিনি বাড়িওয়ালার মেয়েকে দিয়ে ফিরোজের অফিসে টেলিফোন করিয়ে তাকে আনাবেন।