বিয়ের কনেকে সাজিয়েগুজিয়ে দেখাতে হয়। প্রজেক্ট শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে কিছুই দেখাব না।
শালবনের ভেতর দিয়ে পথ। হাসান আগৈ আগে যাচ্ছে, তার কয়েক পা পেছনে লীনা। হাসানের অভ্যাস অতি দ্রুত হাঁটা। লীনাকে তার সঙ্গে সঙ্গে আসতে কষ্ট করতে হচ্ছে। বুকে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। হাসানের হাতে টর্চলাইট। টর্চলাইটের খুব আলো। মনে হচ্ছে জাহাজ থেকে জঙ্গলে সার্চলাইট ফেলা হচ্ছে।
লীনা।
জ্বি স্যার।
শালবনের একটা বিশেষ ব্যাপার কি তোমার চোখে পড়েছে?
আমার চোখ খুব সাধারণ। বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়ে না।
জোনাকি চোখে পড়ছে না?
জ্বি স্যার।
অনেকদিন পর জোনাকি দেখলাম। জোনাকি বলে যে একটা অপূর্ব ব্যাপার আছে–ভুলেই গিয়েছিলাম। জোনাকি পোকার চাষ করা গেলে ভালো হত। মায়ানগরে কৃষ্ণপক্ষের রাতে হাজার হাজর জোনাকিপোকা জ্বলছে— অপূর্ব দেখাবে না?
জ্বি দেখাবে।
জোনাকিপোকা কোন্ আবহাওয়ায় দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে তা জানার চেষ্টা করছি। আমেরিকায় আমার এক বন্ধুকে ই-মেইল করেছি ফায়ার ফ্লাই সম্পর্কে প্রকাশিত সব বই যেন পাঠায়। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। দাঁড়াবে খানিকক্ষণ। রেস্ট নেবে?
লীনা কিছু বলল না। হাসান দাঁড়িয়ে পড়ল। হাতের টর্চ নিভিয়ে দিল। চারদিকে ঘন অন্ধকার। শালগাছের মাথার উপরে তারাভর্তি আকাশ ঝলমল করছে।
হাসান বলল, লীনা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি— তুমি কিছু মনে কোরো না। বাই এনি চান্স, তুমি কি এই চাকরি ছেড়ে ঢাকায় চলে যাবার কথা চিন্তা করছ?
লীনা চমকে উঠে বলল, এই কথা কেন বললেন স্যার?
হাসান বলল, আমার সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আমার সিক্সথ সেন্স আমাকে এই কথাটা বলছে। অবশ্যি সিক্সথ সেন্স আসলে তো কিছু না–অবচেতন মনের চিন্তা। অবচেতন মন নানান তথ্য সংগ্রহ করে শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্তে আসে। এই সিদ্ধান্ত চেতন-মনকে জানায়। চেতন-মন হঠাৎ সিদ্ধান্তের খবর জানতে পারে সে ভাবে সিক্সথ সেন্স তাকে খবরটা দিয়েছে।
লীনা কিছু বলল না।
হাসান বলল, লীনা আমি তোমাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করি–প্রজেক্টটা শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আমার পাশে থাকো। চলো রওনা দেয়া যাক।
হাসান আবারো আগের ভঙ্গিতে দ্রুত হাঁটতে শুরু করেছে। লীনা এখন আর হাসানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত হাঁটছে না। সে পিছিয়ে পড়ছে। তার জন্যে তার খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। তার ইচ্ছা করছে অন্তত কিছু সময়ের জন্যে একা হয়ে যেতে। শালবনের ভেতর সে একা একা ঘুরবে। কেউ তাকে দেখবে না।
তাঁবুতে পৌঁছেই হাসানের কাছে লেখা চিঠিটা লীনা ছিড়ে কুঁচিকুঁচি করে ফেলল। এবং তার স্বভাবমতো বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কাঁদল।
শোবার ঘরের বারান্দায়
শোবার ঘরের বারান্দায় ইয়াকুব সাহেব বসে আছেন। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসা না। শরীর টানটান করে বসা। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি নেই। হাসাল চিন্তিত বোধ করছে। এমন কিছু কী ঘটেছে যে ইয়াকুব সাহেব তার উপর বিরক্ত? এই মানুষটির সঙ্গে তার তেমন পরিচয় নেই। পরিচয় থাকলে হাসান তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে দিতে পারত-মানুষটা বিরক্ত না-কি বিরক্ত না। বিরক্তি প্রকাশের একটা সাধারণ ভঙ্গি আছে! এই মানুষটাকে ঠিক সাধারণের পর্যায়ে ফেলা যাচ্ছে না।
হাসান, ভালো আছ?
জি ভালো আছি।
লণ্ডভণ্ড শব্দটার ইংরেজি জানো?
কোন্ ধরনের লণ্ডভণ্ড মানসিক লণ্ডভণ্ডের এক ইংরেজি, আবার ঘরবাড়ির লণ্ডভণ্ডের আরেক ইংরেজি।
শুনলাম তুমি আমার জায়গাটা লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছ?
হাসান চুপ করে রইল। আলোচনা কোনদিকে যাবে সে এখনো বুঝতে পারছে না।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, লণ্ডভণ্ড কর বা অন্য কিছু কর কিছুই যায় আসে না–যে সময় তোমাকে বেঁধে দিয়েছি, ঐ সময়ে কাজটা শেষ করতে হবে। পারবে?
পারব।
এটা বলার জন্যেই তোমাকে ডেকেছি। তুমি আরো কিছু টাকা চেয়েছিলে। পাঠানো হয়নি। চেকটা রেডি করে রেখেছি তোমাকে হাতে হাতে দেবার জন্যে বসে আছি।
থ্যাংক য়্যু স্যার, আপনি কি এর মধ্যে গিয়ে কাজের প্রগ্রেস দেখবেন?
তুমি কি চাও আমি দেখি?
না, চাই না।
চাও না কেন?
হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, আপনি মায়ানগর বানাচ্ছেন আপনার নাতনীকে চমকে দেবার জন্যে। আমি এটা বানাচ্ছি আপনাকে চমকে দেবার জন্যে। আগেভাগে যদি দেখে ফেলেন, পুরো চমকটা পাবেন না।
শুনেছি তোমার মায়ানগরে অনেক নতুন নতুন ব্যাপার রেখেছ। এর যে-কোনো একটার কথা আমাকে বলো তো। না-যে-কোনো একটা না, তোমার সবচে পছন্দের প্রজেক্টের কথা বলো।
হাসান চুপ করে রইল। কিছু বলল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, হাসান তোমার কাছে কি সিগারেট আছে? ডাক্তাররা আমার জন্যে সিগারেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন। বাড়িতে কোনো সিগারেট নেই। একটা খেতে ইচ্ছা করছে। তুমি একটা সিগারেট ধরাও। আমি একটা ধরাই।
হাসান সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। ইয়াকুব সাহেব খুবই আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট ধরালেন।
হাসান!
জ্বি স্যার।
তোমার সবচে প্রিয় প্রজেক্টের ব্যাপারটা আমাকে বলো। শুনতে ইচ্ছা করছে।
প্রজেক্টের ব্যাপারটা বলার আগে, একটা ছোট্ট গল্প বলতে হবে। গল্পটা শোনার ধৈর্য কি আপনার আছে?
অনেকদিন আমি গল্প শুনি না। শোনাও একটা গল্প। হাসান শোনো, এই সিগারেট শেষ করে আমি কিন্তু আরেকটা সিগারেট খাব।