কী জন্যে জান?
একটা ঘটনা আছে আপা।
চলো যাই।
রাত নটার মতো বাজে। অন্য সময় রাত নটায় ক্যাম্পে প্রচুর আলো থাকে। সারি সারি ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে। আজ কোনো বাতি নেই। শুধু ভঁবুর ভেতর আলো জ্বলছে– এর বাইরে কোনো আলো নেই। লোকজনও নেই। সব কেমন ফাঁকা।
লীনা বলল, লোকজন সব কোথায়?
ডায়নোসর পার্কে গেছে আপা। ঐখানেই ঘটনা।
কী ঘটনা?
হোসেন রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসল। কী ঘটনা সে বলতে চায় না। লীনা ভাবছে— স্যারের সঙ্গে যেই থাকে সেই স্যারের মতো হয়ে যায়। হোসেন প্রথম যখন কাজ করতে আসে তখন প্রচুর কথা বলত। এখন কথাবলা কমিয়ে দিয়েছে। এখন কোনো প্রশ্ন করলেই অবিকল সারের মতো করে রহস্যময় হাসি হাসার চেষ্টা করে।
ডায়নোসর পার্কের ঝিলের পাশে প্রচুর লোকজন। অন্ধকারে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। বিশাল ডায়নোসরগুলিকে কালো পাহাড়ের মতো লাগছে। একজন কে মাঝে মাঝে ডায়নোসরের গায়ে টর্চ ফেলছে, তখন আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে।
হাসান বলল, এখন কেউ টর্চ ফেলবে না।
টর্চের আলো নিভে গেল।
লীনাকে দেখেই হাসান বলল, ম্যাডাম আপনার জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছি।
হাসানের কণ্ঠস্বর তরল, আনন্দময়। লীনা চমকে উঠল। কী আশ্চর্য! স্যার তো এমন ভঙ্গিতে কখনো কথা বলেন না। তার লজ্জা লাগছে, আবার খুব ভালোও লাগছে। লীনা বলল, স্যার কী হচ্ছে?
হাসান বলল, ম্যাজিক হচ্ছে। এখন আমরা ম্যাজিক দেখব। আমাদের ম্যাজিক দেখাবেন, দি গ্রেট জাদুকর মিজু।
মিজু হাসানের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে তার স্বভাবমতো বিড়বিড় করে কিছু বলল। কেউ তার একটা কথাও বুঝতে পারল না।
হাসান বলল, ডায়নোসরগুলি এখনো কমপ্লিট হয়নি। স্টিল ফ্রেমে কংক্রিট দেয়া হয়েছে। শেপ দাঁড়িয়ে গেছে তবে ফাইন্যাল ফিনিসিং হয়নি। ফিনিশিং হবে, রঙ হবে। মোটামুটিভাবে যে-কাজটা শেষ হয়েছে, তা হল যে জলভূমিতে ডায়নোসর দাঁড়িয়ে আছে সেটা। আলোর ব্যবস্থা করা শেষ। আজকে সবাইকে ডেকেছি ব্যবস্থাটা কেমন পরী করার জন্যে। মিজু আমরা কি শুরু করব?
মিজু আবারো বিড়বিড় করল।
হাসান বলল, ওকে লাইট।
বড় জেনারেটরটা এতক্ষণ বন্ধ ছিল। হাসানের কথার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটর চালু হল। ঘড়ঘড় সঙ্গে বনভূমি কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লীনা তাকিয়ে আছে। কোনো কারণ ছাড়াই তার বুক ধ্বকধ্বক করছে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ঝিলের অন্ধকার পানিতে হঠাৎ যেন কিছু হল। পানি দেখা যেতে শুরু করল। আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল তখন। পানিতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা হল। পানি হয়ে গেল গাঢ় নীল। যেন এই ঝিল পার্থিব জগতের না। সত্যি সত্যি মায়ানগরের মাঝিল। গাঢ় নীল পানি পানি থেকে নীলাভ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে ডায়নোসরগুলির গায়ে আলো পড়েছে। ডায়নোসরের ছায়া পড়েছে নীল পানিতে। কী অলৌকিক অবিশ্বাস্য ছবি!
লীনা তাকাল হাসানের দিকে। হাসানের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ঝিলের গাঢ় নীল রঙের পানি যেমন সুন্দর–হাসানের চোখের পানিও সেরকমই সুন্দর।
হাসান বলল, লীনা কেমন দেখলে?
লীনা বলল, স্যার আমি আমার জীবনে এমন অদ্ভুত দৃশ্য দেখিনি।
হাসান বলল, শেষপর্যন্ত এই দাঁড়াবে আমি নিজেও কল্পনা করিনি। পানির রঙ গাঢ় নীল থেকে গাঢ় লাল হবে— এই ব্যবস্থা এখনো শেষ হয়নি। শেষ হলে ট্রায়াল দিয়ে দেখব। এখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই নীল রঙটাই পারফেক্ট।
আমারো সেরকম মনে হচ্ছে স্যার।
হাসান সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, পানির রঙ নীল হবে এটাই স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে আমাদের জায়গাটার নাম মায়ানগর। মায়ানগরের পানির রঙ সবুজ হতে পারে, লাল হতে পারে, বেগুনি হতে পারে। পারে না?
জ্বি স্যার পারে।
আবার সোনালি হতে পারে। কি বলো, পারে না?
জ্বি পারে।
সমস্যা কী জানো চোখে অভ্যস্ত না এমন কোনো রঙ ব্যবহার করলে কিন্তু যে এফেক্ট আমরা আশা করছি তা পাব না। পানির নীল রঙ দেখে আমরা অভ্যস্ত। কাজেই পানির রঙ নীলের কাছাকাছি থাকতে হবে। বলো তোমার এই বিষয়ে কী মত?
লীনা বলল, স্যার আপনি যা বলেন তাই আমার কাছে সত্যি মনে হয়। এখন আপনি যদি বলেন–পানির রঙ কুচকুচে কালো হলে খুব সুন্দর লাগবে। আমার কাছে সেটাই সত্যি মনে হবে।
হাসান বলল, কুচকুচে কালো রঙের পানি দেখে যদি তোমার ভালো না লাগে, তারপরেও কি বলবে আমার কথাই ঠিক?
জ্বি বলব।
কেন বলবে, কোন্ যুক্তিতে বলবে?
তখন আমার মনে হবে, আমার কাছে সুন্দর লাগছে না, কারণ আমার দেখার চোখ নেই।
চলো ফিরে যাই।
চলুন।
ঝিলের পানির রঙ নিয়ে আরেকটা চিন্তা মাথায় এসেছে। চিন্তাটা উদ্ভট, তারপরেও পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
উদ্ভব চিন্তাটা কি আমাকে বলবেন?
না বলব না। লীনা শোননা, আমি ঢাকায় যাচ্ছি। ইয়াকুব সাহেব জরুরি তলব পাঠিয়েছেন। আজ রাতেই দেখা করতে হবে। যত রাতই হোক আমি যেন দেখা করি। তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন। আমার টেনশান লাগছে।
কিসের টেনশান স্যার?
ইয়াকুব সাহেব খেয়ালি ধরনের মানুষ। আমাকে যদি বলেন— এই কাজের এখানেই সমাপ্তি। টাকা অনেক বেশি খরচ হয়ে গেছে। আর খরচ করা যাবে না এই নিয়েই টেনশান।
তিনি মাঝপথে কাজ থামিয়ে দেবেন।
তা দিতে পারেন। খেয়ালি মানুষের খেয়াল হল পানির বুদ্বুদের মতো। দেখতে সুন্দর, কিন্তু ক্ষণস্থায়ী। কে জানে তার নাতনী হয়তো খবর পাঠিয়েছে–সে আসবে না।
লীনা বলল, স্যার আপনি শুধুশুধু টেনশান করবেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ইয়াকুব সাহেবকে একবার যদি এনে আপনি ডায়নোসর পার্ক দেখান তাহলেই হবে।