এখন তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি। তুমি আমার বয়সে বড়, নয়তো তোমাকে আদেশ দিতাম। উপদেশটা হচ্ছে চাকরি ছেড়ে তুমি ঢাকায় চলে এসো। যেদিন চিঠি পাবে সেদিনই। এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
তোমার স্যারকে তুমি প্রাণভোমরা ভাবছ। আসলে তিনি তোমার মরণপাখি। এই পাখি যেই তুমি হাত দিয়ে ছুঁবে অমনি তোমার সব শেষ।
আপা, বুঝতে পারছ কী বলছি? তোমার রেসিপি সরি তোমার না, তোমার গুরুদেবের রেসিপি মো জাপানি খাবার আলিও ওলিও রান্না করলাম। যে কটি অখাদ্য আমি এ জীবনে খেয়েছি তোমার আলিও ওলিও তার মধ্যে একটি। আর এই খাবারের স্বাদের যে বর্ণনা তুমি দিয়েছ, পড়লে মনে হয়–বেহেশতে এই রান্না হয়েছে।
আপা, তুমি এখন যে-অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছ তাতে আমি নিশ্চিত তোমার স্যার যদি গরুর ভূষি অলিভ ওয়েল রসুন এবং শুকনোমরিচ দিয়ে মেখে এনে বলে— এই জাপানি খাবারের নাম ভূষিও আলিও–তুমি গবগ করে খাবে এবং বলবে তুমি তোমার মনুষ্যজীবনে এরচে ভালো খাবার খাওনি।
আমার খুব ভয় লাগছে আপা। তুমি চলে এস, চলে এসো, চলে এসো।
ফিরোজভাই প্রায়ই এসে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। তিনি আগের মতোই হাসিখুশি আছেন, তবে তোমার ব্যাপারে খানিকটা চিন্তিত। সেদিন কথায় কথায় বললেন–তুমি তাকে কোনো চিঠি দাওনি। তুমি তার চিঠির জবাব দিচ্ছ না— এটা কেমন কথা বল তো?
আপা মনে রেখো, বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পুরো পরিবার জলে ভেসে যেতে বসেছিল; ফিরোজ ভাই একা সেই ভেসে যাওয়া পরিবার টেনে তুলেছেন।
ভাইয়ার কথা তোমার মনে পড়ে না আপা? আমাদের সবাইকে কী ভালোই না বসিত! ভাইয়া মারা গেছেন— আমরা ভাইয়াকে ভুলেও গেছি। কিন্তু ভাইয়ার এই বন্ধুটি তাকে ভুলেনি। ফিরোজ ভাই মনে কষ্ট পায় এমন কিছু তুমি কখনো করবে না। কখনো না। কখনো না। কখনো না। চিঠি শেষ করার আগে আরো একবার লিখছি— তুমি চাকরি ছেড়ে চলে এসো।
মা তোমার জন্যে শুকনোমরিচের আচার দিয়ে দিয়েছেন। তোমার খাবার জন্যে, তোমার স্যারের খাবার জন্যে না।
আমার কী ইচ্ছা করছে জানো? আমার ইচ্ছা ঐ ভণ্ডটাকে একটা চিঠি লিখে তার ভণ্ডামি দূর করে দি।
তোমার গুরুদেবকে আমি ভণ্ড বলছি, তুমি নিশ্চয়ই রাগে লাফাচ্ছ। রাগে লাফালেও আমার কিছু করার নেই। আমি তাকে ভওই ডাকব। ভণ্ড ভণ্ড ভণ্ড।
ইতি
বীনা।
লীনা সব চিঠিই তিনবার করে পড়ে। প্রথমবার অতি দ্রুত পড়ে। কী পড়ছে বেশিরভাগই মাথায় ঢুকে না। দ্বিতীয়বার ভাবে ধীরেসুস্থে পড়বে। দ্বিতীয়বার প্রথমবারের চেয়েও দ্রুত পড়ে। তৃতীয়বারের পড়াটা ভালো হয়। লীনা তার বোনের চিঠি একবারই পড়ল। পড়ার পর চিঠিটা একপাশে সরিয়ে রেখে কাগজ কলম হাতে নিল। এক্ষুনি বীনাকে চিঠির জবাব দিতে হবে। প্রচণ্ড রাগ লাগছে। বীনাকে চিঠি না-লেখা পর্যন্ত রাগটা কমবে না। সমস্যা একটাই—কী লিখবে কিছু মাথায় নেই। মাথা ফাঁকা হয়ে আছে।
লীনা লিখল–
বীনা,
তোর চিঠি পড়েছি। খুব ন্যায় কথা লিখেছিস। তারপরেও তোর কথা মানলাম। আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসছি। স্যারকে তুই ভণ্ড বলেছিস। আমি তাতে মনঃকষ্ট পেয়েছি। ভুল বা অন্যায় যা করার আমি করেছি। আমাকে ভণ্ড বলতে চাইলে বলু। উনাকে কেন বলবি?
এই পর্যন্ত লিখে লীনার মনে হল চিঠি লেখার প্রয়োজন নেই। সে তো চলেই যাচ্ছে। আগামীকাল বীনার সঙ্গে দেখা হবে। যা বলার সামনাসামনি বললেই হবে। লীনা চিঠি ছিড়ে ফেলে চাকরি ছেড়ে দেবার বিষয়টা নিয়ে তার স্যারকে লিখতে বসল। রেজিগনেশন লেটার লেখার কিছু নিয়মকানুন আছে। সে ঐসব নিয়মকানুনের ভেতর দিয়ে সে যাবে না। সহজ সরল একটা চিঠি লিখবে। আজই স্যারের হাতে দেবে। স্যার এমন মানুষ যে চিঠি নিয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না।
লীনা লিখল–
শ্রদ্ধেয় স্যার, আমার সালাম নিন। নিতান্তই পারিবারিক কারণে আমি এই চাকরি করতে পারছি না। আমাকে বাড়িতে থাকতে হবে। আপনার সঙ্গে কাজ করা আমার জীবনের আনন্দময় কিছু ঘটনার একটি। আপনি যে বিশাল কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন আমি নিশ্চিত তা আপনি খুব সুন্দরভাবেই শেষ করবেন। এর সঙ্গে আমি শেষপর্যন্ত যুক্ত থাকতে পারব না এটা ভেবেই আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনি ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন এই কামনা।
বিনীতা
লীনা।
কোনো বানান ভুল আছে কিনা বের করার জন্যে চিঠিটী লীনা কয়েকবার পড়ল। যদিও বানান ভুল নিয়ে স্যারের তেমন মাথাব্যাথা নেই। বানানভুল নিয়ে হৈচৈ করবে বীনা। স্যার কখনো করবেন না। চিঠি পড়ে স্যার কী করবেন তাও লীনা জানে। তিনি কোনো প্রশ্ন করবেন না। কোনো সমস্যার জন্যে লীনা কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাও জানতে চাইবেন না। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়বেন— কখন সে যাবে, গাড়ি আছে কি-না এসব জানার জন্যে। চলে যাবার সময় স্যার বলবেন, ভালো থেকো। দুই শব্দের এই বাক্যটি ছাড়া স্যার আর কিছু বলবেন বলে লীনা মনে করে না। না-বলাই ভালো। এরচে বেশি কথা বললে লীনার চোখে অবশ্যই পানি এসে যাবে। সে কাজ ছেড়ে চলে যাচ্ছে অথচ ভেউ ভেউ করে কাঁদছে— এটা হবে অত্যন্ত হাস্যকর একটা ঘটনা। চিঠিটা যে এখনই দিতে হবে এমন কোনো কথা না। লেখা থাকল। কাল ভোরে স্যার যখন নাশতা খেতে বসবেন তখন সে চিঠি দেবে।
লীনা চিঠিহাতে উঠে দাঁড়াতেই বাবুর্চি হোসেন এসে বলল, আপা স্যার আপনাকে ডাকে।
লীনা বলল, স্যার কোথায়?
হোসেন বলল, ডায়নোসর পার্কে। স্যার আমাকে বলেছেন, আপনাকে সাথে করে নিয়ে যেতে।