হাসান তার পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, আপনাদের এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়?
সেক্রেটারি বলল, না। সিগারেট খেতে হলে বারান্দায় গিয়ে খেতে হবে।
আপনাদের বস ইয়াকুব সাহেব তো সিগারেট খান। তিনিও কি বারান্দায় গিয়ে খান?
আপনি নিজেকে উনার সঙ্গে তুলনা করছেন কেন?
হাসান বলল, আমি নিজেকে উনার সঙ্গে তুলনা করছি কারণ আমরা একই গোত্রের। উনি একটা কোম্পানির মালিক, আমিও একটা কোম্পানির মালিক। যত ছোট কোম্পানি, হোক না কেন আমি মালিক তো বটেই। দ্বিতীয় যুক্তি আরো কঠিন—— আমরা দুজনই হমোসেপিয়ান। মানবসম্প্রদায়ের সদস্য। এমন না যে উনি মানুষ আর আমি মানুষ।
লীনা হাসি চেপে রাখতে পারল না। তার এত আনন্দ লাগছে। স্যার মানুষটাকে যুক্তিতে একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলেছেন। সেক্রেটারির চেহারাই এখন কেমন ছাগলের মতো হয়ে গেছে। লীনা মনে মনে বলল, তুই যদি আরো কিছুক্ষণ স্যারের সঙ্গে কথা বলিস তাহলে তোর চেহারা পুরোপরি ছাগলের মতো হয়ে যাবে। থুতনি দিয়ে ছাগলের মতো ফিনফিনে দাড়ি বের হয়ে যাবে রে হাঁদারাম।
হাসান সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি যে এসেছি এই খবরটা স্যারকে দিন। উনি যদি দেখা করতে না চান কোনো সমস্যা নেই, চলে যাব।
দেখা হবে না। টাইমের পর স্যার কারো সঙ্গে দেখা করেন না।
ভাই আপনার নাম কী?
নাজমুল করিম।
হাসান ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল, নাজমুল করিম সাহেব— আমি আপনার ভালোর জন্যই বলছি আমি যে দেরি করে হলেও এসেছি এই খবরটা স্যারের কাছে পৌছানো দরকার। আপনার হয়তো জানা নেই, উনি আমাকে জরুরী তলব দিয়েছেন। প্রয়োজনটা আমার চেয়ে উনার বেশি। কোনো একদিন স্যারের সঙ্গে আমার দেখা হল–আমি তাঁকে বললাম যে আমি এসেছিলাম, কিন্তু সামান্য দেরি হয়েছে বলে আপনি দেখা করতে দেন নি। সেটা কি ভালো হবে?
নাজমুল করিম তাকিয়ে আছে। সে সামান্য ধাঁধায় পড়েছে, কিন্তু আগের সিদ্ধান্ত বদলাবে এরকম মনে হচ্ছে না। হাসান বলল, আচ্ছা ঠিক আছে বিদায়।
নাজমুল করিম বলল, বসুন কিছুক্ষণ। স্যার এখন চা খাচ্ছেন। চা খাওয়া শেষ হলে খবর দিয়ে দেখব। তবে লাভ হবে না। আমি এখানে পাঁচ বছর চাকরি করছি, কোনোদিন স্যারকে দেখিনি ছটার পর কারো সঙ্গে অফিসে কথা বলতে।
হাসান বলল, আমি বরং এই ফাঁকে সিগারেট টেনে আসি। আপনাদের বারান্দাটা কোন্ দিকে বলুন তো?
লীনা সবুজ রঙের সোফায় বসে আছে। তার খুবই টেনশান লাগছে। এখন যদি ইয়াকুব সাহেব বলেন— দেখা হবে না, তাহলে কী হবে? হাসান স্যার লজ্জা পাবেন। এই মানুষটা লজ্জা পাচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগছে। লীনার সামনে সুন্দর একটা চায়ের কাপ ভর্তি হালকা লিকারের রঙ-চা। নাজমুল করিম সাহেব এই চায়ের কাপ তার সামনে রেখেছেন। মানুষটাকে শুরুতে যত খারাপ মনে হচ্ছিল এখন ততটা মনে হচ্ছে না। বরং ভালোমানুষ বলেই মনে হচ্ছে। লীনা চায়ের কাপে চুমুক দিল। সুন্দর গন্ধ। চিনিও দেয়া হয়েছে পরিমাণ মতো। লীনা নাজমুল করিমের দিকে তাকিয়ে বলল, চা-টা খুব ভালো।
নাজমুল করিম বলল, আমাদের বাগানের চা। আমরা মৌলভীবাজারে একটা চায়ের বাগান কিনেছি। ছোট বাগান। চারশ পঞ্চাশ একর।
এখন লীনার নাজমুল করিম মানুষটাকে অনেক বেশি ভালো লাগছে। সে বলেনি–স্যার একটা চা-বাগান কিনেছেন, কিংবা আমাদের কোম্পানি একটা চা-বাগাল কিনেছে। সে বলছে আমরা একটা চা-বাগান কিনেছি। আমরা বলাটাই খুব কঠিন। মালিকের সম্পদ নিয়ে কেউ অহংকার করছে। শুনতে ভালো লাগে।
নাজমুল করিমের টেবিলের উপর রাখা ইন্টারকম বেজে উঠল। লীনার বুক ধড়ফড় করা শুরু হয়েছে এক্ষুনি জানা যাবে যে ইয়াকুব সাহেব তাদের সঙ্গে দেখা করবেন না। কারণ তারা একঘণ্টারও বেশি দেরি করে এসেছে। ইয়াকুব সাহেবের মতো মানুষদের কাছে প্রতি সেকেন্ডেরও অনেক দাম। সেখানে এক ঘণ্টা দশ মিনিট–ইমপসিবল। লীনা চায়ের কাপ রেখে দিয়ে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার ডান পায়ে টনটনে ব্যথা। যে কোনো টেনশানে ইদানীং তার এই সমস্যা হচ্ছে। পা ব্যথা করছে। কোনো একজন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে ভাল হত। টেনশানে মানুষের বুক ব্যথা করে। কিন্তু পা ব্যথা তো করে না। তার বেলায় সবকিছু এমন উল্টা কেন?
নাজমুল করিম ইন্টারকমের রিসিভার রেখে লীনার কাছে এগিয়ে এসে বললেন— স্যার আপনাদের ডাকছেন।
ইয়াকুব সাহেবের কামরাটা পুরোটাই কাঠের। মেঝে, দেয়াল, মাথার উপরের ফলস সিলিং সবই কাঠ। ঘরে ঢোকেই প্রথম কথা যা মনে আসে তা হল—বাহ্ সুন্দর তো। তারপর আসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চারদিক দেখার প্রশ্ন। লীনা কোনো কিছুই খুঁটিয়ে দেখছে না। সে তাকিয়ে আছে ইয়াকুব নামের মানুষটার দিকে। সে মনে মনে ভাবছে ইয়াকুব নামের এই মানুষটার সঙ্গে তার যদি হঠাৎ কোথাও দেখা হত তাহলে কি সে বুঝতে পারত— ইনি অসম্ভব বিত্তবান একজন মানুষ।
কাঠের বড় গোলটেবিলের পেছনে ছোট্ট চেয়ারে বৃদ্ধ একজন মানুষ জবুথবু হয়ে পা গুটিয়ে বসে আছে। মাথার চুল ছোট ছোট করে কাটা। মাথা কামানোর পর চুল গজালে যেমন দেখায় তেমন দেখাচ্ছে। ভদ্রলোকের মনে হয় শাদা রঙের প্রতি দুর্বলতা আছে। তার পরনের পায়জামা পাঞ্জাবি শাদা, গায়ে চাদর জড়িয়ে রেখেছেন, চাদরটাও শাদা। ভদ্রলোকের গায়ের রঙও অতিরিক্ত শাদা। গোল মুখ। তীক্ষ্ণ চোখ–জ্বলজ্বল করছে। লীনার যে ব্যাপারটা ভালো লাগল–তা হচ্ছে দ্রলোক খুব আগ্রহ নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। ইয়াকুব সাহেবের মতো মানুষরা যে অবস্থানে আছেন সেই অবস্থান থেকে কেউ অন্যদের দিকে এত আগ্রহ করে তাকায় না। আগ্রহ করে তাকানোকে বিত্তবানরা দূর্বলতা মনে করে।