হাসান বলল, অন্তু তোমাকে বলেনি? আমরা জঙ্গলে জোছনা দেখতে যাচ্ছি। বলেছে, নাকি বলেনি।
নাজমা শান্ত গলায় বলল, বলেছে।
হাসান বলল, দুর্দান্ত একটা চাঁদ উঠেছে। আমরা রাত দুটা পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে জোছনা দেখব। দুটার পর ঘুমুতে যাব। তোমার জন্যে গাড়ি স্ট্যান্ডবাই থাকবে। ঘুম ভাঙলেই গাড়ি করে চলে আসতে পারবে। আর যদি মনে কর— একটা দিন বাচ্চারা স্কুল মিস করা এমন কিছু না— তাহলে থাকবে। আমি আমাদের কাজের অগ্রগতি তোমাকে দেখাব। তোমার টাসকি লেগে যাবে।
নাজমা চুপ করে রইল।
হাসান নীতুর দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে বুড়ি জঙ্গলে যাবি?
নীতু বলল, না।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তরে সে না বলে। তার এই না মানে বেশির ভাগ সময়ই হ্যাঁ।
হাসান বলল, আমাদের খাবারের কোনো ব্যবস্থা করতে হবে না। আমরা পথ থেকে একটা বিগ সাইজ পিজা কিনে নেব।
নাজমা বলল, তুমি টাওয়েল পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। গা মুছে কাপড় পরে টেবিলে এসে বস। আগে কথা বলি।
হাসান বলল, তোমার কথা বলার টোনটা ভালো লাগছে না। এতদিন পরে এসেছি, এখন ঝগড়া করতে ইচ্ছা করছে না।
নাজমা বলল, ঝগড়া করব না। শান্তভাবেই কয়েকটা কথা বলব। তুমি চাইলে হাসিমুখেই বলব।
হাসান বলল, তুমি ঝগড়া করতে চাইলে ঝগড়া করতে পার। চিৎকার চেঁচামেচি করতে পার— আমার দিকে চায়ের কাপ বা গ্লাসও ছুড়ে মারতে পার— শুধু জঙ্গলে জোছনা দেখার ব্যাপারে না বোলো না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি একা জোছনা দেখতে পারি না।
নাজমা বলল, তুমি কাপড় বদলে বারান্দায় বসো–আমি নীতুকে খাইয়ে আসছি। তখন কথা হবে।
হাসান বারান্দায় বসে আছে। হাসানের পাশে ব্যাগ হাতে অন্তু। নাইলনের নীল রঙের দড়ি ছাড়া অন্তুর ব্যাগে সবই নেয়া হয়েছে, শুধু তার পেন্সিলটর্চের ব্যাটারি নেই। হাসান তাকে কয়েকবার আশ্বস্ত করেছে ব্যাটারি কেনা হবে, অন্তু কেন জানি ভরসা পাচ্ছে না। রাস্তার ওপাশের দোকানটা খোলা আছে। অন্তুর ইচ্ছা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে এক্ষুনি সে ব্যাটারি কিনবে।
নাজমা নিজের জন্যে মগভর্তি চা নিয়ে হাসানের পাশে বসল। অন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, অন্তু তুমি ঘরে যাও। তোমার বাবার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলব।
অন্তু বলল, আমাদের তো দেরি হয়ে যাচ্ছে মা।
দেরি হলেও কিছু করার নেই। তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা আগে শেষ হতে হবে। ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরে যাও।
অন্তু ঘরে চলে গেল। নাজমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, তুমি ঢাকায় এসেছ এক মাস আঠারো দিন পর।
হাসান বলল, কী যে কাজের চাপ যাচ্ছে তুমি এখানে বসে কল্পনাও করতে পারবে না।
আমি তোমাকে তিনটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম, তুমি তার একটার জবাব দিয়েছ। তিন লাইনের জবাব।
একবার তো বলেছি প্রচণ্ড কাজের চাপ।
এতই যখন কাজের চাপ, তাহলে জোছনা দেখানোর জন্যে চলে এলে কেন? কাজের মধ্যে জোছনা কী?
নাজমা তুমি ঝগড়া করার চেষ্টা করছ।
ঝগড়া করছি না। তোমার সঙ্গে আলাপ করছি। আলাপ করার জন্যে তোমাকে পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেছে। ভাগ্যিস তোমাদের জঙ্গলে একটা চাঁদ উঠেছিল।
এই-যে কথাগুলি বলছ, চলো এক কাজ করি–জঙ্গলে জোছনায় বসে আলাপ-আলোচনা যা হবার হোক।
নাজমা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কাপ পাশে রাখতে রাখতে বলল, শুরুতেই বিষয়টা পরিষ্কার করে নেয়া ভাল। আমি তোমার সঙ্গে যাচ্ছি না।
যাচ্ছ না মানে?
যাচ্ছি না মানে যাচ্ছি না। তোমার সঙ্গে জোছনা দেখার আমার শখ নেই। কারো সঙ্গেই নেই।
অন্তু ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে।
এটাও তোমার চমৎকার ট্রিকস-এর একটি। অন্তুকে আগেভাগে বলেছ। সে ব্যাগ গুছিয়ে অপেক্ষা করছে। তুমি জানো এটা আমার উপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। যেতে ইচ্ছা না করলেও ছেলের শুকনোমুখ দেখে আমি যাব। তোমার ট্রিকস আজ কাজ করবে না। আমি যাব না।
যাবে না?
অবশ্যই না। আমাকে বা অন্তু নীতুকে তোমার প্রয়োজনও নেই। দুএকজন মুগ্ধ মানুষ তোমার আশেপাশে থাকলেই হল। সেরকম মানুষ তোমার সঙ্গে আছে। তোমার পি.এ, আছে না! মেয়েটার নাম কী যেন?
লীনা।
হ্যাঁ লীনা। মেয়েটার নাম আমি জানি, তারপরেও তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমি দেখাতে চাচ্ছিলাম তুমি তার নামটা কত মিষ্টি করে উচ্চারণ কর।
খুব মিষ্টি করে কি উচ্চারণ করেছি?
হ্যাঁ করেছ। মুগ্ধ মানবী একজন তো তোমার সঙ্গেই আছে। শুধুশুধু আমাদের নিতে এসেছ কেন?
নাজমা তুমি ভুল লজিক ধরে এগুচ্ছ। তুমি আমার সঙ্গে যাবে না ভালো কথা। মেয়েটাকে শুধু শুধু টানছ কেন?
মেয়েটাকে টানছি কারণ আমি তোমার স্বভাবচরিত্র জানি। তুমি যখন কিছু বলার জন্যে মাথার ভেতর কথা গুছাও–তখন তোমার মুখের দিকে
তাকিয়ে আমি বলে দিতে পারি তুমি কী বলতে যাচ্ছ।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই প্রমাণ দেব?
প্রমাণ দিতে হবে না। প্রমাণ ছাড়াই আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি।
তারপরেও প্রমাণ দেই। জোছনা উপলক্ষে তুমি তোমার মায়ানগরে মোটামুটি একটা হৈচৈ ফেলে দিয়েছ। জোছনা-উৎসবের আয়োজন করেছ। করনি?
উৎসবের আয়োজন করিনি। তবে কাজকর্ম বন্ধ রেখেছি। জেনারেটর চালু হয়নি।
লীনা মেয়েটিকে বলনি শাদা শিফন পরে জোছনায় হাঁটতে? চাঁদের আলোয় শাদা শিফন পরলে মনে হবে জোছনার কাপড় পরা হয়েছে। এই কথা একসময় আমাকে বলেছ— আরো অনেককে বলেছ। তাকেও নিশ্চয় বলেছ। বলনি?
হ্যাঁ বলেছি।
জাপানি খাবার রান্না করে খাওয়াও নি? আলিও ওলিও, কিংবা টমেটো বেসড স্পেগেটি পমরো। নিশ্চয়ই খাইয়েছ।