ইয়াকুব সাহেব আগ্রহ নিয়ে বললেন, জুন মাসে আসবে। সে তার জন্মদিন এখানে করবে।
তার আগেই কি শিশুপার্ক না কী যেন বানাচ্ছেন সেটা শেষ হবে?
অবশ্যই হবে। এক্সপার্টের হাতে পড়েছে। কাজ হচ্ছে মেশিনের মতো।
দেখেছেন?
না দেখিনি। নাতনীর সঙ্গে দেখব। তবে কাজ কেমন আগাচ্ছে সে রিপোর্ট প্রতিদিন পাচ্ছি।
উঠি। শরীরটা ভালো লাগছে না। বিশ্রাম করব।
বোস ভাক্তার বোস। আরেকটু বোস। শরীর ভালো লাগছে না এইজনেই তো বেশি বসা দরকার। বোস গল্প কর।
মোহিত সাহেব অনিচ্ছার সঙ্গে বসে আছেন। ইয়াকুব সাহেব অতি বুদ্ধিমান মানুষ। কেউ একজন তার সামনে অনাগ্রহ নিয়ে বসে থাকবে এটা বুঝতে না-পারার কোনো কারণ তার নেই। কিন্তু মোহিত সাহেবের মনে হচ্ছে ইয়াকুব সাহেব এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না।
ডাক্তার!
জ্বি।
তুমি যেটাকে শিশুপার্ক বললে, সেটা আসলে পার্ক না। তার নাম দেয়া হয়েছে, মায়ানগর। নামটা কেমন?
খারাপ না।
মায়ানগর নামটা ভালো, না-কি মায়াপুরী?
একই।
মায়ানগরে যাবার পর তোমার চোখে মায়া লেগে থাকবে। যাই দেখবে মনে হবে মায়া-বিভ্ৰম-জাদু।
ভালো তো।
একটা ডায়নোসর পার্ক হচ্ছে। দশটা নানান ধরনের ডায়ানোসর বানানো হচ্ছে। ডায়নোসরগুলি কিন্তু মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবে না। এক হাঁটু পানিতে থাকবে।
ও।
ডায়নোসর তো স্থবির। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় না। কাজেই এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে যাতে তাদের স্থবিরতা খানিকটা দূর হয়।
ও।
কী করা হয়েছে শোনো। যে পানির উপর ডায়নোসরগুলি দাঁড়িয়ে আছে–সেই পানির রঙ পরিবর্তনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভোরবেলায় পানির রঙ থাকবে গাঢ় নীল। যতই সময় যাবে পানির রঙ বদলাতে থাকবে। ঠিক সন্ধ্যায়, সূর্য ডোবার সময় পানির রঙ হবে গাঢ় লাল। পানির নিচে থাকবে লাইটিঙের ব্যবস্থা। তোমার কাছে ব্যবস্থাটা কেমন লাগছে?
খারাপ না।
আমি শুনে মুগ্ধ হয়েছি। এই বয়সে আমি যদি মুগ্ধ হই তাহলে বাচ্চাদের অবস্থা কী হবে চিন্তা কর।
আজ উঠি। সামান্য কাজও আছে। বড়মেয়ের শাশুড়ি আজমির শরিফ যাচ্ছেন। আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।
কাল পরশু আবার এসো, মায়ানগরের অন্য প্রজেক্টগুলির কথা বলব। কুবরিকের একটা ছবি আছে, তুমি হয়তো দেখনি 2001 Space odessg, আর্থার সি ক্লার্কের উপন্যাস নিয়ে বানানো ছবি। সেখানে একটা অদ্ভুত স্লেভ আছে। মসৃণ স্লেভ–অনেকদূর পর্যন্ত উঠেছে। সেখান থেকে বিচিত্র সুরের সংগীত শোনা যায় সেই ব্যবস্থাও হচ্ছে। আমার কাছে ডিজাইনের কপি আছে। তোমাকে দেখাব।
আচ্ছা।
ইয়াকুব সাহেব ছেলেমানুষের মতো কিছুক্ষণ পা নাচালেন। হাতের কাছে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরালেন। এতক্ষণ আনন্দে ছটফট করছিলেন হঠাৎ সব আনন্দ দূর হয়ে গেল। তার মনে হল এলেনা শেষপর্যন্ত আসবে না। যাবার তারিখ ঠিকঠাক হবে, প্লেনের টিকিট কাটা হবে। তখন বড় ধরনের কোনো ঝামেলা হবে। এলেনার মাম্পস হবে। কিংবা তার স্কুল থেকে ঠিক করা হবে ছাত্রছাত্রীদের সামার-ক্যাম্পে যেতে হবে। এলেনা নিজেই ডিজাইন করে একটা কার্ড পাঠাবে। সেই কার্ডে লেখা থাকবে : Grandpa Sorry.
এর আগেও দুবার এই ঘটনা ঘটেছে। এবারেরটা নিয়ে হবে তিনবার। কথায় বলে দানে দানে তিনবার। তবে এবার যদি এলেনা আসতে না পারে তাহলে আর তার সঙ্গে দেখা হবে না। এই সত্য ইয়াকুব সাহেব খুব ভালো করে জানেন। তিনি নিজেকে গুটিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তাঁর কাজকর্ম বহুদূর ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, কখনো মনে হয়নি একটা সময় আসবে যখন কাজ গুটানোর প্রয়োজন পড়বে। কাজ ছড়ানো যেমন কঠিন, গুটানোও কঠিন। ছড়ানোর ব্যাপারটা আনন্দময়, গুটানোর কাজটা বিষাদমাখা।
ইয়াকুব সাহেব ভুরু কুঁচকালেন। হিসেবে কিছু ভুল হচ্ছে–তিনি আসলে কাজ গুটাচ্ছেন না। আরো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এলিনের জন্মদিনে বাজারে নতুন একটা চা আসছে। তার নিজের বাগানের চা। চায়ের নাম ঠিক হয়েছে। এদেশের সবচে বড় বিজ্ঞাপনসংস্থাকে দেয়া হয়েছে নতুন চায়ের কেমপেইন ঠিকমতো করতে। পোস্টার দিয়ে সারাদেশ মুড়ে দিতে হবে। টিভির যে-কোনো চ্যানেল খুললে প্রতিদিন অন্তত দুবার যেন চায়ের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। তিনি যতদূর জানেন টিভি স্পট তৈরির কাজ শেষ হয়ে গেছে। কম্পিউটার গ্রাফিক্সের কিছু কাজ হচ্ছে বোম্বেতে। একটা বিজ্ঞাপনচিত্রের আইডিয়া তার খুব পছন্দ হয়েছে। গম্ভীর ধরনের বাবা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে চা খাচ্ছেন। তার ফুটফুটে ছ-সাত বছরের বাচ্চামেয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। হাতে একটা পিরিচ। বাবা পিরিচে খানিকটা চা ঢেলে দিলেন। মেয়ের মুখে হাসি। সে পিরিচের চায়ে চুমুক দিচ্ছে। লেখা ফুটে উঠল : ইয়া-চা।
ইয়াকুব সাহেব নিজেকে সব কর্মকাণ্ড থেকে সরিয়ে রাখবেন, এ ধরনের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে ঘটনা সে রকম ঘটবে না। তার শরীর খুবই অসুস্থ্য। ডাক্তাররা মোটামুটি ইংগিত দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর উচিত বড় যাত্রার প্রস্তুতি নেয়া। ব্যাগ গোছানো। তা না করে তিনি শেষ মুহূর্তে আরও বড় কাজে ঝাপিয়ে পড়তে চাচ্ছেন। চা কোম্পানির চা বাজারজাত করার নানান পরিকল্পনা তার মাথায় আসছে। চায়ের নাম তার পছন্দ হচ্ছে না। নামের ব্যাপারে তিনি এখন একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন।
অসংখ্য নামের মধ্যে ইয়াকুব সাহেবের ইয়া-চা নামটা পছন্দ হয়েছে। ইয়াকুব নামের প্রথম দুটি অক্ষর ইয়া-চার মধ্যে আছে সেজন্যে না। ইয়া শব্দটাই আনন্দময়। ইয়াকুব সাহেবের ধারণা, ঠিকমতো বিজ্ঞাপন চালিয়ে যেতে পারলে মানুষদের মধ্যে একটা ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া যাবে— চা কয় রকম? দুরকম। সাধারণ চা এবং ইয়া-চা।