ইয়াকুব সাহেব বললেন, কেমন আছ মনসুর?
মনসুর বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ভালো আছি স্যার।
বোস।
মনসুর বসল। ইয়াকুব সাহেবের সামনে একটা নিচু চেয়ার রাখা। মনসুর এসে বসবে এইজন্যেই রাখা। ইয়াকুব সাহেবের শোবার ঘরে খাট ছাড়া কোনো আসবাবপত্র নেই।
ইয়াকুব সাহেব পা দোলাতে দোলাতে বললেন, জয়দেবপুরে আমাদের যে প্রজেক্ট চলছে–শুনলাম তুমি দেখতে গিয়েছিলে।
মনসুর বলল, এই নিয়ে তিনবার গিয়েছি স্যার। মাঝখানে একবার গিয়ে দুই দিন দুই রাত ছিলাম।
কেমন দেখলে?
বললে আপনি রাগ করবেন, টাকাপয়সার হরির লুট চলছে। হাসান নামে যাকে কাজ দিয়েছেন সে বাতাসে টাকা ওড়াচ্ছে। নিজের টাকাতো না, পরের টাকা নষ্ট করতে মায়া লাগে না। দেখে কষ্ট লাগল।
খুব টাকা ওড়াওড়ি হচ্ছে?
দুইটা জেনারেটর আছে— তারপরেও আরেকটা নতুন জেনারেটর কেনা হয়েছে। রাজশাহী থেকে মাটির ঘরের কারিগর এসেছে দশ জন। এদের কোন কাজকর্ম নাই। খাওয়া দাওয়া করছে। ঘুরাফিরা করছে। পরের টাকা হলেই এমনভাবে ওড়াতে হবে?
তাতো ঠিকই। পরের টাকায় মায়া স্বাভাবিকভাবেই কম থাকবে–তাই বলে এত কম থাকাও তো ঠিক না। কাজকর্ম হচ্ছে কেমন?
কাজকর্মেরও কোনো আগামাথা দেখলাম না। প্রথম একটা জায়গায় খাল কাটা শুরু হয়েছে–একশো কুলি সারাদিন কাজ করল। সন্ধ্যাবেলা হাসান সাহেব বললেন, না, খালটা এখানে হবে না। অন্য দিক দিয়ে হবে।
খুব খাল কাটাকাটি হচ্ছে?
কী যে হচ্ছে না বোঝা স্যার মুসকিল। লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। প্রতিদিনই কিছু না-কিছু যন্ত্রপাতি আসছে। একটা বুলড়জার ভাড়া করেছে— বুলডজারটা খামাখা পড়ে আছে। এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবহার দেখলাম না।
কথা বলেছ হাসানের সঙ্গে?
জ্বি না। ইচ্ছা করে নাই।
রাতে ঘুমিয়েছ কোথায়?
থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা। অন্যের টাকা-তা, সমানে খরচ করতেছে। বিরাট ঘর আছে, ভালো বাথরুম, খাওয়াও ভালো।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, টাকা খরচ করতে পারা কিন্তু সহজ ব্যাপার। অনেকেই টাকা খরচ করতে পারে না। ধর কাউকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বললে ইচ্ছামতো খরচ কর। দশ দিন পরে খোঁজ নিতে গেলে কত খরচ হয়েছে। দেখা গেল খরচ করতে পেরেছে তিন হাজার টাকা।
মনসুর বলল, এই লোক খরচ পারে। এক কোটি টাকা এই লোক দশ দিনে খরচ করবে।
ইয়াকুব বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। এক কোটি টাকার প্রাথমিক বাজেট সে শেষ করে ফেলেছে। তাকে আরো টাকা দিতে হবে।
মনসুর চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলতে পারলনা। বয়স হলে মানুষের মাথা আউলা হয়ে যায়। আউলা মানুষ কী করবে না করবে বুঝতে পারে না। এই বুড়োর দেখি সেই ঘটনাই ঘটেছে। মাথী ফোর্টি নাইন হয়ে গেছে।
ইয়াকুক সাহেব বললেন, ঠিক আছে মনসুর তুমি যাও।
মনসুর কিছু না বলে বের হয়ে গেল। তার মন খুব খারাপ হয়েছে। সামান্য দুই লাখ টাকার কারণে তার চাকরি চলে গেছে অথচ কোটি টাকার কোনো হিসাব নাই। বেকুবি ছাড়া এর আর কী মানে হতে পারে। আল্লাহপাক এরকম কেন? বড় বড় বেকুবের কোলে টাকার বস্তা ঢেলে দিয়েছে। ঘটনা কি তাহলে এরকম যে, যত বড় বেকুব, তার তত টাকা।
মনসুর ঘর থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়াকুব সাহেবের ব্যক্তিগত ডাক্তার ঘরে ঢুকলেন। বয়স্ক মানুষ। প্রাকটিস অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছেন, তবে ইয়াকুব সাহেবের চিকিৎসা করেন। ভদ্রলোকের নাম আবদুল মোহিত। স্বল্পভাষী মানুষ। নানাবিধ ব্যাধিতে সারাবছর ভুগছেন। তিনি রোগের ব্যারোমিটার। ঢাকা শহরে যে কোন রোগ তাকে দিয়ে প্রথম শুরু হবে।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, শরীর কেমন ডাক্তার?
ডাক্তার সাহেব বললেন, মোটামুটি।
পা ফুলে গিয়েছিল বলেছিলে। পায়ের ফোলা কমেছে?
কিছু কমেছে।
বাইরে কোথাও গিয়ে শরীর দেখিয়ে আসো।
দেখি।
মোহিত সাহেব ব্লাডপ্রেশারের যন্ত্রপাতি বের করে ইয়াকুব সাহেবের ব্লডিপ্রেশার মাপলেন। রক্ত নিলেন। ইউরিনের স্যাম্পল তৈরি ছিল সেটিও নিলেন। মোহিত সাহেব কিছুদিন হল একটি প্যাথলজিক্যাল ল্যাব দিয়েছেন। ইয়াকুব সাহেবের রক্ত ইউরিন কিছুদিন পরপরই সেখানে পরীক্ষা করা হয়।
ডাক্তার সাহেব বললেন, আমি যাই।
ইয়াকুব সাহেব বললেন, কিছুক্ষণ বোস গল্প করি।
ডাক্তার সাহেব বসলেন। তাঁর মুখ বিষণ্ণ। গল্প করার ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। ইয়াকুব সাহেব বললেন, চুপ করে আছ কেন? কথা বলো।
মোহিত সাহেব বললেন, কী কথা বল?
যা তোমার বলতে ইচ্ছা করে। কিছু বলতে ইচ্ছা না করলে চুপচাপ সামনে বসে থাকো।
মোহিত সাহেব চুপচাপ সামনে বসে রইলেন। ইয়াকুব সাহেব বললেন, সিগারেট খাবে?
না। ছেড়ে দিয়েছি।
একটা খেয়ে দেখ। মৃত্যুর সময় তো এসেই গেছে। মনের সব সাধ আহ্লাদ মিটিয়ে ফেলা ভালো।
মোহিত সাহেব কিছু বললেন না।
ইয়াকুব সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, জয়দেবপুরে আমি যে বিরাট একটা কাজে হাত দিয়েছি শুনেছ নাকি?
শুনেছি।
আমার নাতনী আসবে। নাতনীকে এবং আমার মেয়েকে চমকে দেবার ব্যবস্থা।
চমকে দেবার জন্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন?
হুঁ করছি।
মোহিত সাহেব লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, টাকা আছে খরচ করতে অসুবিধা কী? পাঁচ কোটি টাকা খরচ করলে— এক মাসের ভেতর অন্য কোনো ব্যবসা থেকে পাঁচ কোটি টাকা চলে আসবে।
তা হয়তো আসবে। না আসলেও অসুবিধা নেই।
মোহিত সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে বসে আছেন। একেবারেই কোনো কথা না-বলা অভদ্রতা হয় ভেবেই হয়তো বললেন, আপনার নাতনী কবে আসবে?