ফিরোজ বলল, তুমি যখন আংটিটা আমার কাছে দিয়ে বললে তুমি পরিয়ে দাও তখন আমার বলতে ইচ্ছা করল–আমার পরিয়ে দেয়াটা শোভন হবে না। তুমি বরং আংটিটা তোমার স্যারের কাছে নিয়ে যাও। উনি মুরুব্বিমানুষ। উনি পরিয়ে দেবেন। হা হা হা।
লীনাও হেসে ফেলল। তার আঙুলে পরানো আংটির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল— হীরের আংটি নাকি?
ফিরোজ বলল, হ্যাঁ হীরের আংটি। আমি খুবই দরিদ্র মানুষ। দিনে আনি দিনে খাই অবস্থা। তারপরেও আমি ঠিক করে রেখেছিলাম এমন একটা আংটি তোমাকে আমি দেব যার গল্প তুমি কোনো-একদিন তোমার পুত্র-কন্যাদের করবে। তুমি তাদের বলবে–যখন আমাদের বিয়ে হয় তখন তোমার বাবার খুবই খারাপ অবস্থা। একটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে সে চাকরি করত, সেই চাকরিও চলে গেছে। তারপরেও তোমার বাবা পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে একটা হীরের আংটি কিনে দিয়েছিল।
লীনা হতভম্ব গলায় বলল, আংটিটার দাম পঁচিশ হাজার টাকা?
ফিরোজ বলল, না— ষোলো হাজার টাকা। গল্প করার সময় তুমি নিশ্চয়ই একটু বাড়িয়ে বলবে। বলবে না?
লীনা বলল, তোমার ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চাকরিটা নিশ্চয়ই এখনো আছে।
হ্যাঁ আছে। তবে যাই যাই করছে।
যাই যাই করছে কেন?
বুঝতে পারছি না। আমি লক্ষ্য করেছি বা আমাকে পছন্দ করে না। নিশ্চয়ই আমার চরিত্রে এমন কিছু আছে যা মানুষকে বিরক্ত করে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, কিছুক্ষণ কথা বললেই একজন মানুষ অন্যজনকে পছন্দ করা শুরু করে। আমার বেলায় উল্টোটা ঘটে। কেউ আমার সঙ্গে আধঘণ্টা কথা বললে সে আমাকে অপছন্দ করবে এটা নিশ্চিত। লীনা আংটিটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। খুব সুন্দর আংটি। এত দাম দিয়ে আংটি কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
তোমার জন্যে হয়তো প্রয়োজন নেই। আমার জন্যে প্রয়োজন। তুমি ধরেই নিতে পার— এটাই হবে তোমাকে দেয়া আমার একমাত্র দামি উপহার। আমার পরের উপহারগুলি দু-শো আড়াইশো টাকা দামের শাড়িতে সীমাবদ্ধ থাকবে।
ঢাকায় যাবার গাড়ি হর্ন দিচ্ছে। বীনাকে দেখা যাচ্ছে ব্যাগ হাতে গাড়ির পাশে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফিরোজ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল : দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি-বেলা দ্বিপ্রহর…।
রাত দশটা।
হাসান তার বিছানায় এলোমেলো ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পায়ের ব্যথা তীব্র হয়েছে। ক্লোফেনাক ট্যাবলেট সে কিছুক্ষণ আগে খেয়েছে। ব্যথা তেমন কমেনি, তবে শরীর ঝিম ধরে আসছে। মনে হচ্ছে ব্যথা না কমলেও ঘুম চলে আসবে। তাঁবুর ভেতর আলো জ্বলছে। রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল, হাসান ফেরত পাঠিয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলছে, কোনো খাবার মুখে দিতে ইচ্ছা করছে না।
লীনা তাঁবুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভীত গলায় বলল, স্যার আসি?
হাসান বলল, এসো।
লীনা তাঁবুর ভেতর ঢুকল। সে রাত আটটা থেকেই ভাবছে স্যারকে দেখে আসবে। কেন জানি সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেনি। হাসান যখন রাতের খাবার ফেরত পাঠান তখন তার মনে হল— যাওয়া উচিত। একটা মানুষ ব্যথায় ছটফট করবে আর সে আরাম করে ঘুমাবে, এটা কেমন কথা।
স্যার ব্যথা কি খুব বেশি?
ব্যথা ভালোই আছে।
আদার রস মেশানো গরম পানিতে পা ডুবিয়ে রাখলে ব্যথা কমবে।
হাসান উঠে বসতে বসতে বলল, এই চিকিৎসা কোথায় পেয়েছ?
আমার বাবাকে করতে দেখেছি। পা মচকে গেলে তিনি গরম পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতেন।
এইসব লাগবে না। সকালে ডাক্তার আসবে। রাতটা পার করতে পারলেই হবে।
লীনা বলল, স্যার আমি আদা মিশিয়ে গরম পানি আনতে বলেছি।
পানি নিয়ে এলে তো পা ডুবাতেই হবে। তোমার অতিথিরা শুনলাম চলে গেছে।
জ্বি স্যার। পূর্ণিমার সময় আবার আসবে।
আমাদের প্রজেক্ট তাদের কেমন লাগল?
ভালো লেগেছে।
খুব ভালো, না মোটামুটি ভালো?
খুব ভালো। আচ্ছা স্যার, মরুভূমির যে-ঘরটা আমরা বানাচ্ছি ঐটা…
লীনা কথার মাঝখানে চুপ করে গেল। হাসান কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে তার অতিথিরা মরুভূমির ঘর নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেছে। লীনার মনে প্রশ্নটা আছে, তবে স্যারকে বলতে পারছে না। স্যার আবার কিছু মনে করেন। লীনার একটা ব্যাপার হাসানের ভালো লেগেছে–স্যার আমরা যে ঘরটা বানাচ্ছি। সে বলতে পারত যে ঘরটা বানানো হচ্ছে। তা সে বলেনি।
লীনা প্রশ্নটা শেষ কর। তেমন কিছু না স্যার।
তবু শুনি।
মরুভূমিতে কেউ যখন দাঁড়াবে তখন সে দেখবে চারপাশে সবুজ ঘাস, গাছপালা। তার খটকা লাগবে না?
হাসান বলল, চারপাশের গাছপালা তো কেউ দেখতে পারবে না। মরুভূমির চারদিকে পাহাড়ের মতো করা হচ্ছে। দৃষ্টি পাহাড়ে আটকে যাবে। ঝিল কেটে যে মাটি উঠবে, সেই মাটি দিয়ে পাহাড় হবে। পাহাড়ের গায়েও বালি দিয়ে দেয়া হবে। মূল ডিজাইনে আছে। শেলফ থেকে ডিজাইনটা আননা, আমি তোমাকে দেখাচ্ছি।
দেখাতে হবে না স্যার আমি বুঝতে পারছি।
আরো ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। কেউ যদি মনে করে। যে-কোনো দিক দিয়ে মরুভূমিতে ঢুকতে পারবে তাহলে সে ভুল করবে। সরাসরি সেখানে যাবার পথ নেই। খাল কেটে জায়গাটা আলাদা করা।
সেখানে যাবার ব্যবস্থা কী?
টানেলের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। অনেকক্ষণ অন্ধকার টানেলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হবে। টালেনের মুখ দিয়ে বের হওয়া মাত্র সে ঝলমলে আলোর জগতে এসে পড়বে। এটা দেখ, এটা হচ্ছে টানেল সাড়ে ছয় ফুট ডায়ামিটার। কাগজ আর কলম নাও–একটা মজার জিনিস বুঝিয়ে দিচ্ছি।
লীলার কেমন যেন লাগছে। স্যার খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু কোনো কথা তার কানে ঢুকছে না। তার কাছে মনে হচ্ছে বিরাট বনভূমিতে সে এবং তার স্যার। আর কেউ নেই। গভীর রাত— জোছনায় বনভূমি ভেসে যাচ্ছে। স্যার হাঁটছেন সেও হাঁটছে। খুব বাতাস হচ্ছে। বাতাসের ঝাপটায় তার লম্বা চুল মাঝে মাঝে স্যারের চোখেমুখে পড়ছে। তার খুব লজ্জা লাগছে। আবার কেন জানি খুব ভালো লাগছে।
ইয়াকুব সাহেব তাঁর শোবার ঘরে
ইয়াকুব সাহেব তাঁর শোবার ঘরে, খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। এই সময় তার অফিসে থাকার কথা। আজ অফিসে যাননি। অফিসের পুরনো কর্মচারী মনসুরকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এক বছর হল মনসুরের কোনো চাকরি নেই। অফিসের দুই লাখ টাকার হিসেবে গণ্ডগোল হবার পর তার চাকরি চলে গেছে। তারপরেও সে নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করে। সে পুরনো কর্মচারীদের একজন। এই হিসেবে তাকে প্রতিমাসেই আগের বেতনের কাছাকাছি পরিমাণ টাকা দেয়া হয়। অফিসে তার বসার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। সবার টেবিলে সে বসে। পুরনো দিনের গল্প করে। চা-টা খায়। চাকরি চলে গেলেও অফিসে তার অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ ইয়াকুব সাহেব মাঝে মাঝে তাকে ডেকে নিয়ে গল্প করেন।