সব পাখি জোড়ায় জোড়ায় ওড়ে পক্ষীকুলে শুধুমাত্র চিলকেই নিঃসঙ্গ উড়তে দেখা যায়। নিঃসঙ্গতার আনন্দের সঙ্গে এই পাখিটির কি পরিচয় আছে?
উড়ন্ত চিল দেখার পরপরই হাসানের মাথায় পাখি বিষয়ক একটা চিন্তা এসেছে— মরুভূমির ঘরগুলিতে কবুতর থাকার ব্যবস্থা করলে কেমন হয়। পোষ মানিয়ে শত শত কবুতর যদি রাখা যায়! যত অদ্ভুত, যত সুন্দরই ঘরগুলো হোক না কেন, ঘরের কোনো প্রাণ থাকে না–শত শত কবুতর যদি সেই ঘরগুলি ঘিরে ওড়াওড়ি করতে থাকে, তবেই ঘরগুলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে।
বিকেল পাঁচটার সময় সাইট থেকে ঢাকায় একটা গাড়ি যায়। তার পরের গাড়িটা ছাড়ে রাতের ডিনারের পর পর। দশটা-সাড়েদশটা বাজে। ফিরোজ বিকালের গাড়িতে যাবে বলে ঠিক করেছে। তার রাতে থেকে যাবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু বীনাকে যেতেই হবে। পরীক্ষা সামনে, একটা মিনিট নষ্ট করার সময়ও তার নেই। তাছাড়া ঢাকায় মা একা। একটা কাজের মেয়ে ছিল, সেও পাঁচ কেজি চালের একটা ব্যাগ এবং লীনার দুটা ব্যবহারী শাড়ি নিয়ে সরে পড়েছে। এখন বাড়িতে মা একা।
বীনা বলল, মা বাড়িতে একা–এটা কোনো সমস্যা না। একৗ থাকা তাকে অভ্যাস করতে হবে। আমরা দু-বোন বিয়ে করে চলে যাব, মাকে তখন তো একা থাকতেই হবে। মা নিশ্চয়ই প্ল্যান করছেন পুঁটলি-পাঁটলা নিয়ে জামাইএর বাড়িতে উঠবেন।
লীনা বলল, তুই এমন কঠিন কথা কীভাবে বলিস।
বীনা বলল, খুব সহজভাবে বলি। কথাগুলি মোটেই কঠিন না। কথাগুলি বাস্তব। বাস্তব আমাদের ভালো না লাগলেও স্বীকার করতে হবে।
ফিরোজ হাসতে হাসতে বলল, বাস্তবতা তাহলে এই দাঁড়াচ্ছে যে তুমি বিকেল পাঁচটায় চলে যাচ্ছ।
বীনা বলল, আপনার কি থাকার ইচ্ছা নাকি?
ফিরোজ বলল, জঙ্গলে কোনোদিন রাত কাটাইনি। জঙ্গলে রাত কাটাতে কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছা করছিল, কিন্তু তুমি ঢাকায় গেলে আমি অবশই যাব। আমি তোমাকে একা ছেড়ে দেব না।
আমি কি কচি খুকি।
কচি খুকি হও বা বুড়ি নানী হও, আমি তোমাকে একা ছাড়ব না। আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি, সঙ্গে নিয়ে যাব।
তাহলে চলুন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলি।
আমার ব্যাগ সব সময় গোছানোই থাকে। তুমি তোমার ব্যাগ গুছাও।
লীনা তাঁবুর ভেতরের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। ফিরোজ তার পাশে বসতে বসতে বলল, শরীর খারাপ নাকি?
লীনা বলল, না।
ফিরোজ বলল, আমরা চলে যাব। আমাদের হাসিমুখে বিদায় দাও। উঠে বোস। যাবার আগে তোমার হাতে এক কাপ চা খেয়ে যাই।
লীলা উঠে বসল। বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, তোমরা থেকে যাও। স্যার থেকে যেতে বলেছেন।
ফিরোজ বলল, তোমার স্যার কী বলছেন বা না বলছেন তা তোমার কাছে যত গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ না। তোমার বলাটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমি বলছি থেকে যাও।
একটা বিশেষ কারণে আমার নিজ থেকেই থেকে যাবার ইচ্ছা ছিল— তুমি না বললেও এটা আমার পরিকল্পনার মধ্যেই ছিল। বীনা যেহেতু যাচ্ছে কাজেই আমাকে যেতেই হবে।
লীনা বলল, বিশেষ কারণটা কী?
ফিরোজ বলল, শালবনের দিকে চলো। হাঁটতে হাঁটতে বিশেষ কারণটা বলি। এখানে বলা যাবে না। বীনা যে-কোনো সময় এসে পড়বে।
লীমা বলল, আমার হাঁটতে ইচ্ছা করছে না। এখানেই বলো।
তুমি মনে হয় এখনো আমার উপর রেগে আছ। রাগটা একপাশে সরিয়ে আমার সঙ্গে চলো তো। প্লিজ। তোমার স্যার সম্পর্কে কঠিন কোন কথা বলে যদি তোমাকে হার্ট করে থাকি আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
ক্ষমা প্রার্থনার কী হল?
কিছু নিশ্চয়ই হয়েছে। নয়তো এত রাগ তুমি করবে না। লীনা শোনো, আমি সর্ব অর্থে একজন প্রতিভাশূন্য মানুষ। প্রতিভাধরদের এইজন্যে প্রচণ্ড হিংসা হয়। যা বলি হিংসা থেকে বলি। এটা আমার চরিত্রের প্রধান ত্রুটিগুলির একটি। এই ক্রটি তোমাকে ক্ষমা করতে হবে। চলো একটু হাঁটতে যাই। পাঁচটা বাজতে এখনো পঁয়ত্রিশ মিনিট দেরি আছে। আমরা তার আগেই চলে আসব।
লীনা স্যান্ডেল পরল। তাঁবুর পেছনেই শালবন। তাদের বেশি হাঁটতে হল না। ফিরোজ বলল, বইপত্রে পড়েছি জঙ্গলের পুর্ণিমা অসাধারণ হয়। নেক্সট পূর্ণিমায় আমি চলে আসব।
লীনা বলল, চলে এসো।
ভরা পুর্ণিমায় হাত ধরাধরি করে তোমাকে নিয়ে বনে হাঁটব। আশাকরি তোমার স্যার রাগ করবেন না।
স্যারের কথা এখানে আসছে কেন? স্যার কেন রাগ করবেন?
তাঁর লয়েল কর্মচারী কোম্পানির স্বার্থ চিন্তা না করে অন্য একজন পুরুষমানুষের হাত ধরে হাঁটছে। রাগ করার কথা তো।
উনার সঙ্গে এইভাবে কথা বলবে না।
ঠাট্টা করছিলাম।
লীনা বলল, আমার সঙ্গে ঠাট্টাও করবে না। আমি ঠাট্টা বুঝি না।
ফিরোজ বলল, আচ্ছা যাও ঠাট্টাও করব না। সবসময় সিরিয়াস কথা বলব।
ফিরোজ তার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতে দিতে বলল, তোমার জন্যে সামান্য একটা উপহার এনেছি।
কী উপহার?
একটা আংটি।
হঠাৎ আংটি দেবার দরকার পড়ল কেন?
কী আশ্চর্য, তোমাকে আমি একটা আংটি দিতে পারব না। তোমার আঙুলে হয় কি-না দেখ।
লীনা বলল, তুমি পরিয়ে দাও।
ফিরোজ হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলল। লীনা বলল, হাসছ কেন?
একটা বিশেষ ঠাট্টা করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ঠাট্টাটার কথা মনে করেই হাসি আসছে। ঠাট্টাটা করতে ইচ্ছা করছে— আমি আবার প্রমিজ করেছি ঠাট্টা করব না। শোনো লীনা— একটা শেষ ঠাট্টা করি। আর কোনোদিন করব না। প্রমিজ বাই ইওর নেম।
লীলা বলল, কর। ঠাট্টা কর। ঠাট্ট করা যার স্বভাব সে ঠাট্টা না করে থাকতে পারবে না।