নাজমুল আলম কোরেশি, তোমার ডাক নাম কী?
বাবুল।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, ঘাসের উপর বস। প্যান্ট অবশ্যি নোংরা হবে। তাতে কী?
নাজমুল বসল। হাসান তার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলল, সিগারেটে টান দিতে ইচ্ছা করলে টান দাও। আমাকে লজ্জা করার কিছু নেই। চাকরি কেমন লাগছে?
ভালো লাগছে।
ভালো লাগার কী আছে? কোনো কাজ নেই। তিনবন্ধু একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছ। চাকরি করতে এসেছ। ঘুরে বেড়াতে তো আসেনি।
কী করব বুঝতে পারছি না স্যার। কোনো দায়িত্ব যদি পাই চেষ্টা করতে পারি।
বিশেষ কোনো দায়িত্ব কি তুমি নিতে চাও?
আমি সেইভাবে চিন্তা করিনি স্যার।
নকল মরুভূমির মাঝখানে কিছু অদ্ভুত ধরনের ঘর তৈরি হচ্ছে–শুনেছ নিশ্চয়।
জ্বি।
তার ডিজাইন দেখেছ?
জ্বি না।
ডিজাইনটা আমার ড্রাফট-টেবিলে আছে। ডিজাইনটা খুব ভালোমতো দেখবে। ঘরে বিশেষ ধরনের লাইটিং হবে। দরজা জানালা দিয়ে গাঢ় হলুদ আলো আসবে। বালির উপর হলুদ আলো পড়ে বালি চিকচিক করবে। বিল্ডিঙের বাইরেও হলুদ আলো ফেলা হবে। লাইটের সোর্স এমন হবে যে সোর্স দেখা যাবে না। কেউ বুঝতেও পারবে না— আলো কোথেকে আসছে।
ডিজাইনে নিশ্চয়ই এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
অবশ্যই রাখা হয়েছে। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে লাইটিঙের ব্যাপারটা দেখা। তোমার সঙ্গে একজন ডিপ্লোমা ইনজিনিয়ার থাকবে। রহিম নাম। খুবই এক্সপার্ট। তার কাছ থেকে অনেককিছু শিখতে পারবে। সমস্যায় পড়লে মিজুর সাহায্য নেবে। মিজুকে চেনো?
জ্বি না।
খুঁজে বের করবে। তার সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্টা করবে। এই খাতিরটা কাজে লাগবে।
জ্বি আচ্ছা।
লাইটিং প্ল্যানে বড় একটা ভুল আছে। ভুলটা বের করে আমাকে বলবে। আমি দেখতে চাই তোমার বুদ্ধি কেমন! আচ্ছা এখন যাও।
নাজমুল চলে যাচ্ছে। খুব উৎসাহ নিয়ে যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ! মনে হয় ছেলেটা টিকে যাবে। হাসান সিগারেট ধরাল। ছোট্ট ভুল হয়েছে। ফ্লাস্কে করে চা আনা উচিত ছিল। চা খেতে ইচ্ছা করছে। হাসান নাজমার চিঠি খুলল। কী সুন্দর পরিষ্কার ঝকঝকে লেখা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে।
হাসান,
চিঠিতে কঠিন কঠিন কথা লেখা আমার খুব অপছন্দ। কঠিন কথা সামনা সামনি হওয়া উচিত। যে মানুষটা দূরে আছে, চিঠি লিখে তাকে হার্ট করার কোনো অর্থ হয় না। তারপরেও বাধ্য হয়ে তোমাকে কঠিন চিঠি লিখছি।
অন্তু এবং নীতুর জ্বর তুমি দেখে এসেছ। সাধারণ জ্বর না, বাড়াবাড়ি ধরনের জ্বর। তারপরেও তুমি ঢাকা ছেড়ে চলে গেলে। কিছু টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব পালন করলে। একবার খোঁজ নিলে না, ওদের জুর কেমন। পনেরো দিনে একবারও তোমার ঢাকায় আসার কথা মনে পড়ল না। জয়দেবপুর ঢাকা থেকে এমন কোনো দূরত্বে অবস্থান করছে না।
আমার ব্যাপারে তোমার আগ্রহ ফুরিয়ে গেছে এটা আমি যেমন জানি তুমি তারচে অনেক ভালো করে জানো। তারপরেও বাচ্চাদের প্রতিও তুমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
Workaholic কথাটার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। কাজ নিয়ে নেশাগ্রস্ত মানুষ অবশ্যই আছে। সন্তানের প্রতি দায়িত্ব পালনও কিন্তু কাজেরই অংশ। বারে তারিখে আমার জন্মদিন গিয়েছে। আমি নিশ্চিত ছিলাম, এই দিনটা তোমার মনে থাকবে এবং ঢাকায় এসে হৈ চৈ করে (মেকি হৈ চৈ) কাটাবে।
অঙ্কু এবং নীতুকেও বললাম– আজ তোমাদের বাবা আসবে। অন্তু এটা শুনেই বলল, সে আজ স্কুলে যাবে না। বাচ্চাদের স্কুল কামাই আমি খুবই অপছন্দ করি। তারপরেও বললাম আচ্ছা ঠিক আছে যেতে হবে না। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দার বেতের চেয়ারটায় বসে তোমার জন্যে অপেক্ষা করেছে। তার একবারও টিভির কার্টুন চ্যানেল ছাড়ার কথা মনে হয় নি।
আমি বুঝতে পারছি অন্তুর অপেক্ষার কথা শুনে তোমার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাই স্বাভাবিক। আবার এও বুঝতে পারছি চিঠি পড়ে পুত্রপ্রেমে পাগল হয়ে তুমি হা পুত্র হা পুত্র করতে করতে ছুটে আসবে না। তুমি তোমার মতো কাজ করবে।
বারো অরিখে আমি অন্তুর মতো বারান্দায় বসে না-থাকলেও অপেক্ষা করেছি। বুঝতে পারছি সূতায় প্রকল টান পড়েছে। একটা সুতাকে দুজন দুদিকে টানছি। যে-কোনো মুহূর্তে সূতা ছিড়বে। সূতা ছিড়লে ক্ষতি নেই, কিন্তু সূতা ধরে অন্তু এবং নীতু ঝুলছে। ওদের কী হবে কে জানে।
একটা সময় ছিল যখন পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে এখনো আমাদের বিয়ে হয়নি। তোমার সঙ্গে আমার সামানাই পরিচয়। আমি গ্রামের বাড়িতে আছি। হুট করে এক দুপুরে তুমি উপস্থিত। আমার প্রাচীনপন্থী বাবা খুবই রেগে গেলেন। তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না অতি সামান্য পরিচয়ে কী করে একটা ছেলে ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে একটি মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত হয়। তোমাকে তৎক্ষণাৎ বিদায় করা হল। তুমি নান্দাইল রোড স্টেশনে গিয়ে বসে রইলে ফিরতি ট্রেনের অপেক্ষায়। দুপুরবেলা আমি এসে তোমাকে স্টেশন থেকে বাসায় নিয়ে গেলাম।
যাই হোক, তুমি তোমার স্বপ্নরাজ্য সাজাতে থাকে। অন্তু এবং নীতুর জ্বর সেরেছে। তারা ভালো আছে। তাদের নিয়ে টেনশান করার কিছু নেই। মানসিক দিক দিয়ে আমি ক্লান্তিবোধ করছি। ক্লান্তি কাটানোর জন্যে চিটাগাঙে মেজভাইয়ার কাছে যাচ্ছি। সেখান থেকে টেকনাফে যাবার কথা। তোমার বাচ্চারা আসন্ন ভ্রমণের আনন্দে উল্লসিত। তুমি ভাল থেকো।…
হাসান উঠে দাঁড়াল। সূর্য মাথার উপর উঠে এসেছে। রোদে মাথা চিড়বিড় করছে। পায়ের যন্ত্রণাও বাড়ছে। পা টেনে টেনে এতদূর আসাটা বোকামি হয়েছে। ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। হাসান আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে চিল উড়ছে।