জ্বি আচ্ছা স্যার।
যাকে পাঠাবে তার বায়োডাটার কাগজটা একটা ইনভেলপে ভরে সিল করে তার হাতে দিয়ে দেবে। ইনভেলপে কী আছে তাকে বলবে না। শুধু বলবে ইনভেলপটা যেন আমার হাতে দেয়।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তুমি তোমার গেস্টদের কাছে যাও— আজ তোমার ছুটি।
লীনা ফিরোজ এবং বীনাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছে। লীনা যাচ্ছে আগে আগে। লীনার পেছনেই বীনা। তার পেছনে ফিরোজ। লীনা এমন ভঙ্গিতে হাঁটছে যেন পুরো অঞ্চলটা তার চেনা। যেন এটা তারই রাজত্ব। সে রাজত্ব দেখতে বের হয়েছে। অথচ জায়গাটা সে মোটেই চেনে না। পরশুদিনই সে একবার শালবনে হারিয়ে গিয়েছিল। শালবন থেকে কোন দিকে বের হবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। আজও সে শালবনের ভেতরই ঢুকেছে।
ফিরোজ বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
লীনা বলল, বালির পাহাড় দেখতে যাচ্ছি।
ফিরোজ বলল, বালির পাহাড় মানে?
লীনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, দু-শো ট্রাক বালি এনে ফেলা হয়েছে। মায়মেনসিং সেভ। মোটাদানার বালি। আরো দু-শো ট্রাক বালি আসবে। চারশো ট্রাক বালির দাম চার লাখ টাকা। এক হাজার টাকা করে ট্রাক।
বীনা বলল, বালির দাম কত তাও তোমার জানতে হয়?
লীনা বলল, বালির দাম কত জানতে হয় না। জানার ইচ্ছা হয়েছিল— ক্যাশিয়ারকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি।
ফিরোজ বলল, চারশো ট্রাক বালি দিয়ে কী হবে? মরুভূমি বানানো হবে নাকি?
লীনা বলল, ঠিক ধরেছ। নকল মরুভূমি বানানো হচ্ছে। আমাদের দশ একর প্লেন ল্যান্ড আছে। পুরোটা বালি দিয়ে ঢাকা হবে। ঠিক মাঝখানে মাটির কিছু উঁচু উঁচু ঘর তৈরি হবে। ঘরগুলি একটার গায়ে একটা লেগে আছে। অদ্ভুত ড্রিজইন। দেখলেই গা শিরশির করে। স্যারের ড্রয়িংবোর্ডে ডিজাইন আছে। তুমি দেখতে চাইলে ডিজাইন এনে দেখাব। আইডিয়াটা অদ্ভুত না? মরুভূমির মাঝখানে কিছু স্ট্রেঞ্জ লুকিং উচু উঁচু মাটির ঘর।
ফিরোজ বলল, লীনা তুমি কিছু মনে করো না–আমার কাছে নকল মরুভূমির ব্যাপারটা খুব হাস্যকর মনে হচ্ছে।
লীনা বলল, হাস্যকর কেন?
ফিরোজ বলল, মরুভূমির মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুমি যদি চারদিকে সবুজ গাছপালা দেখ, শালবন দেখ— তাহলে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যায় না? এমন এক মরুভূমি তৈরি হচ্ছে যার চারপাশে সবুজের ছড়াছড়ি।
লীনা আহত গলায় বলল, স্যার হাস্যকর কাজ কখনো করবেন না। চারপাশের গাছপালা যেন দেখা না যায় সেরকম কোনো ব্যবস্থা অবশ্যই নেয়া হবে।
ফিরোজ বলল, ব্যবস্থা নেয়া হলে তো ভালোই। তুমি এমন রাগ করছ কেন?
স্যার সম্পর্কে কেউ হেলাফেলাভাবে কথা বললে আমার খুব রাগ লাগে।
কেন, রাগ লাগবে কেন? উনি কি মহাপুরুষ নাকি।
লীনা কঠিন গলায় বলল, উনি মহাপুরুষ না। উনি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষ হয়েও উনি স্বপ্ন তৈরি করার কাজ করেন।
ফিরোজ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, তিনি কিন্তু নিজের স্বপ্ন তৈরি করার কাজ করেন না। অন্যের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করেন। অন্যের ফরমায়েসি স্বপ্ন অন্যের অর্থে তৈরি করা।
লীনা দাঁড়িয়ে পড়ল। চাপা গলায় বলল, প্লিজ স্টপ ইট। বালির পাহাড় দেখতে হবে না। চলো ফিরে যাই।
ফিরোজ বলল, তুমি অকারণে রাগ করছ। রেগে আগুন হবার মতো কোনো কথা আমি বলিনি। কিছু সত্যিকথা বলেছি। চলল তোমার বালির পাহাড় দেখে আসি।
না দেখতে হবে না।
লীনা উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করল। বীনা এসে পাশে দাঁড়াল। বীনা চাপা গলায় বলল, তুমি এরকম ছেলেমানুষি করছ কেন আপা?
লীনা বলল, কী ছেলেমানুষি করলাম।
তুমি কাঁদছ। কাঁদার মতো কিছু হয়নি। তুমি অবশ্যই চোখ মুছে আমাদের বালির পাহাড় দেখাতে নিয়ে যাবে। আপা চোখ মোছো।
লীনা চোখ মুছল।
আপা, তুমি কি জানো যে তুমি খুব অস্বাভাবিক আচরণ করছ?
জানি না। মন খারাপ হয়েছে এইটুকু জানি।
মন খারাপটা এত ঘন ঘন না করে একটু কম করলে হয় না আপা।
আমার মধ্যে তোর মতো কোনো সুইচ নেই যে, মন খারাপের সুইচ অফ করে মন ভালো করার সুইচ অন করে দেব।
চোখ মোছে আপা। আবার তোমার চোখে পানি।
লীনা চোখ মুছল।
হাসান ঝিলের পাড়ে একা বসে আছে। জায়গাটা ঝিল না— নিচু জায়গা। প্রজেক্টে এই জায়গার নাম দেয়া হয়েছে ঝিল। মাটি কেটে কৃত্রিম ঝিল বানানো হবে। মাটি কাটার লোকজন আছে– এখনো মাটিকাটা শুরু হয়নি। ঝিলের জন্যে জায়গাটা হাসানের পছন্দ হচ্ছে না। জায়গাটা নিচু বর্ষায় এমনিতেই পানি জমে থাকে। সুবিধা বলতে এইটুক। হাসানের মতে ঝিলটা শালবনের ভেতর দিয়ে যাবে। ঝিলের পানি হবে কাকচক্ষুর মতো টলটলে। পানি খুব গভীর হবে না, সূর্যের আলো যতটুকু যেতে পারে তটুকুই গভীর হবে।
স্যার আমাকে ডেকেছেন?
হাসান পাশ ফিরল। তার পা ভালোই যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। সে পা নাড়িয়ে শুধু পাশ ফিরেছে। এতেই পা টনটন করছে।
লীনা আপা এই খামটা আপনাকে দিতে বললেন।
হাসান খাম হাতে নিল।
আপনার একটা চিঠি এসেছে। চিঠিটাও আপা আপনাকে দিতে বলেছেন।
থ্যাংক য়্যু।
হাসান ব্যক্তিগত লেখা খামটা চোখের সামনে ধৰ্বল। নাজমার চিঠি। ডাকে আসেনি–হাতে হাতে এসেছে। প্রতিদিনই একটা গাড়ি ঢাকা থেকে আসছে, ঢাকায় যাচ্ছে। চিঠি আনা-নেয়া কোনো সমস্যা না। হাসানের মনে হল— অতি দ্রুত এমন কোনো ব্যবস্থা করা উচিত যেন সরাসরি চিঠি চলে আসে।
সেইসঙ্গে একজন পাস-করা ডাক্তারও দরকার। জরুরি কিছু ওষুধপত্র।
হাসান নাজমার চিঠি রেখে অন্য খামটা খুলল। নাজমুল আলম কোরেশির বায়োডাটা। হাসান লীনাকে বলেছিল যে-ছেলেটিকে পাঠাবে তার বায়োডাটা সঙ্গে দিয়ে দিতে। কীজন্যে বলেছিল, এখন মনে পড়ছে না। সে কি অতিরিক্ত চাপের মধ্যে আছে? আছে হয়তো।