- বইয়ের নামঃ বৃষ্টি ও মেঘমালা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ পার্ল পাবলিকেশন্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না
গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।
চাবি ঘুরালে ভররর জাতীয় ক্ষীণ শব্দ হচ্ছে। শব্দে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। হাসান লীনার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বলল, কী করা যায় বল তো?
লীনা ঢোঁক গিলল। হাসানকে সে অসম্ভব ভয় পায়। অফিস বসকে ভয় পাওয়া দোষের কিছু না। ভয় লাগামছাড়া হওয়াটা দোষের। হাসান জিজ্ঞেস করেছে— কী করা যায় বল তো। নির্দোষ প্রশ্ন। স্মার্ট মেয়ে হিসেবে লীনার বলা উচিত ছিল— স্যার চলুন আমরা একটা ক্যাব নিয়ে চলে যাই। তা না বলে সে ঢোঁক গিলছে। ঢোঁক গেলার মত প্রশ্ন তো না। পি এ-র প্রধান দায়িত্ব বসের মেজাজের দিকে লক্ষ্য রাখা। তার সমস্যার সমাধান দেবার চেষ্টা করা। তা না করে সে খাতাপত্র নিয়ে জড়ভরতের মতো বসে আছে।
হাসান বলল, লীনা কটা বাজে দেখ তো।
লীনা আবারো ঢোঁক গিলল। তার হাতে ঘড়ি নেই। সবদিন ঘড়ি থাকে, শুধু আজই নেই। ঘড়ি পরতে ভুলে গেছে। সে যখন বাসা থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠেছে তখন তার মা দোতলার বারান্দায় এসে বলেছেন, লীনা তুই ঘড়ি ফেলে গেছিস। লীনা বলেছে, থাক লাগবে না। এটা না করে সে যদি রিকশা থেকে নেমে ঘড়িটা নিয়ে আসত। তাহলে সময় বলতে পারত।
হাসান বলল, তোমার ঘড়ি নেই?
না স্যার।
ঘড়ি কিনে নাও না কেন? ঘড়ি ছাড়া কি চলে। এই সময়ে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঘড়ি দেখতে হয়। ঘড়ি তো এখন সস্তা। তিনশ চারশ টাকায় সুন্দর সুন্দর ঘড়ি পাওয়া যায়।
লীনা চুপ করে রইল। তার বলা উচিত ছিল, স্যার আমার ঘড়ি আছে। আজ তাড়াহুড়া করে অফিসে এসেছি বলে ঘড়ি আনতে ভুলে গেছি। এইসব কিছু না বলে সে মনে মনে ইয়া মুকাদ্দেমু, ইয়া মুকাদ্দেমু পড়ছে। বিপদে পড়লে আল্লাহর এই নাম জপলে বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়।
তারা তো এখন বিপদেই পড়েছে। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি আটকে আছে। অন্য কোনো সময় হলে গাড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়াটা তেমন বিপদজনক হত না। কয়েকজন টোকাই এনে গাড়ি ঠেলতে ঠেলতে গ্যারাজে নিয়ে যাওয়া যেত। আজকের ঘটনা অন্য, ইয়াকুব সাহেবের অফিস থেকে বলা হয়েছে— পাঁচটা থেকে দুটার মধ্যে আসতে হবে। এই সময়ের মধ্যে এলেই স্যারের সঙ্গে দেখা হবে। ইয়াকুব সাহেবের কাছ থেকে বড় একটা কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা। কাজটা পাওয়া খুব দরকার। লীনাদের আফিসে গতমাসে হাফ-বেতন হয়েছে। এই মাসে হয়তো বেতনই হবে না। হাসান স্যারের দিকে তাকালে লীনার খুবই মায়া লাগে। মানুষটা চারদিক থেকে ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। গত তিনমাস অফিসের ভাড়া দেয়া হয়নি। ইলেকট্রিসিটি বিল দেয়া হয়নি। টেলিফোন বিল দেয়া হয়নি। প্রতিদিন অফিসে গিয়ে লীনা প্রথম যে-কাজটা করে তা হল টেলিফোন রিসিভারটা তুলে কানে দেয়। ডায়েল-টোন আছে কি-না তার পরীক্ষা। ডায়াল-টোন থাকা মানে– অফিস এখনো বেঁচে আছে।
লীনা!
জ্বি স্যার।
কী করা যায় বল।
লীনা কী বলবে? তার মাথায় কিছুই আসছে না। তার এই ভেবে খারাপ লাগছে যে মানুষটাকে সে সাহায্য করতে পারছে না।
চল গাড়ি ফেলে রেখে বেবীটেক্সি নিয়ে চলে যাই।
এর উত্তরেও লীনা কিছু বলতে পারল না। রাস্তার মাঝখানে গাড়ি ফেলে গেলে কী হয় কে জানে। গাড়ির মালিকদেরই এটা ভালো জানার কথা। লীনাদের গাড়ি নেই। তার কোনো আত্মীয়স্বজনদেরও গাড়ি নেই। লীনার ছোটমামী একবার একটা পুরনো ট্রাক কিনেছিলেন। কথা ছিল তিনি সবাইকে ট্রাকে নিয়ে সাভার যাবেন। সেষ্টা হয়নি। কারণ ট্রাক কেনার সাতদিনের মাথায় এক্সিডেন্ট করে সেই ট্রাক একটা মানুষ মেরে ফেলল। ছোটমামা ট্রাক বিক্রি করে দিলেন।
লীনা?
জি স্যার।
শেষ চেষ্টা করে দেখি। গাড়ি ঠেলতে হবে। পারবে না?
পারব স্যার।
তুমি একী পারবে না। আরো কয়েকজন জোগাড় কর।
লীনা লোক জোগাড় করার জন্যে ছুটে রাস্তা পার হতে গিয়ে রিকশার ধাক্কা খেয়ে হাত কেটে ফেলল। টুপ টুপ করে রক্ত পড়ছে। কিন্তু লীনা খুবই আনন্দিত যে এক্সিডেন্টের দৃশ্যটা স্যার দেখেননি। তিনি গাড়ির বনেট খুলে কী যেন করছেন। স্যার ব্যাপারটা দেখলে খুবই লজ্জার ব্যাপার হত। লীনা কাকে বলবে গাড়ি ঠেলতে? আর বলবেই বা কীভাবে? ভাই আমাদের গাড়িটা একটু ঠেলে দেবেন? কোন ধরনের লোকদের এই কথা বলা যায়? লীনা আবারো ইয়া মুকাদ্দেমু পড়তে লাগলো।
তারা মতিঝিলে পৌঁছল ছটা সতেরো মিনিটে।
সেক্রেটারি টাইপ এক লোক শুকনো মুখে বলল, আপনাদের তো পাঁচটার মধ্যে আসার কথা।
হাসান বলল, দেখতেই পাচ্ছেন, কথামতো আসতে পারিনি। স্যার কি আছেন না চলে গেছেন?
স্যার আছেন। তবে সময়ের পর স্যার কথা বলেন না।
কথা বলেন না কেন–গলায় কোনো প্রবলেম? কথা বলতে কষ্ট হয়? ফেরেনজাইটিস?
সেক্রেটারি রাগীচোখে তাকিয়ে আছে। লীনা অনেক কষ্টে হাসি চেপে আছে। বেশিক্ষণ হাসি চাপতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না। অথচ এখন তার হাসির সময় না। কাজটা তারা পাচ্ছে না। সেক্রেটারি লীনার দিকে তাকিয়ে আছে। এখন যদি তিনি লীনার হাসি দেখে ফেলে তাহলে খুব সমস্যা হবে। লীনা অফিসঘর দেখতে লাগল। কী সুন্দর সাজানো অফিস। সবকিছু ঝকঝক করছে। একেক জনের বসার জায়গা কাচ দিয়ে ঘেরা। প্রত্যেকের সামনে একটা করে কম্পিউটার এরকম একটা কাচের ঘর যদি লীনার থাকত।