করিম সাহেব নিজে এই লাটি রাত দশটার দিকে লাগিয়ে দেন। সব ভাড়াটেদের কাছে এর একটা চাবি আছে। দশটার পর এলে নিজেদের চাবিতে গেট খুলতে হয়।
জালাল মিয়া একা আসে নি আরো লোকজন এসেছে। কান্না-কাটির কোনোরকম আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে করিম সাহেব এখনো টিকে আছেন। নিচে একবার যাওয়া উচিত কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি কমে আসছে। বাতাসের বেগও কমছে। ঘটাং-ঘটাং করে জানালার একটা পাট এতক্ষণ নড়ছিল। এখন আর নড়ছে না।
পরপর তিনটি সিগারেট শেষ করে আহসান ঘুমুতে গেল। তার ধারণা ছিল—ঘুম আসবে না, অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার শোয়ামাত্রই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। রোদে ঝলমল করছে চারদিক। ঘড়িতে বাজছে নটা। চমৎকার সকাল। মন ভালো করে দেবার মতো চমৎকার।
আশ্চর্যের ব্যাপার মেয়েটি তাকে কিছু না বলেই চলে গেছে। বিছানা পরিপাটি করে গোছানো। পরনের শাড়ি ভাঁজ করে আলনায় রাখা। বারান্দায় এক পাটি স্যান্ডেল ছিল সেটিও নেই। মেয়েটি গেট দিয়ে বেরুবার সময় কেউ কি দেখেছে? আহসানের অস্বস্তির সীমা রইল না। একটা বিশ্রী ব্যাপার হয়ে গেল।
একতলায় কে যেন রেডিও চালিয়েছে। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে কেউ একজন এক ঘেঁয়ে গলায় ভ্যাজার-ভ্যাজর করছে।
ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক। যে-বাড়ির প্রধান ব্যক্তিটি হাসপাতালে মর-মর সেবাড়িতে শিল্প-সাহিত্য শুনবার জন্যে কেউ রেডিও খুলবে এটা ভাবা যায় না। আহসান বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রেডিও বন্ধ হয়েছে। কেউ বোধ হয় মনের ভুলে সুইচ টিপেছিল।
এ-রকম হয়। তারিন মারা যাবার পর ঠিক এই জিনিসই হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে আহসান একটা বেবিটেক্সি নিয়ে চলে গেল ঝিকাতলার বাসায়। সেই সময় বাসায় আসার তার কোনোই প্রয়োজন ছিল না। কেন যে এসেছে সে সম্পর্কে তার ধারণাও স্পষ্ট নয়। পাশের বাড়ির নীলা ভাবি বললেন, হাসপাতাল থেকে আসছেন নাকি ভাই? খবর আছে কিছু?
আহসান কিছু বলল না। নীলা ভাবি বললেন, বুঝতে পারছি আনন্দের কোনো খবর এখনো হয় নি। এত যখন ঝামেলা হচ্ছে তখন ছেলে হবে। ছেলেগুলো বড় ঝামেলা করে রে ভাই। সহজে পৃথিবীতে আসতে চায় না।
আহসান জবাব না দিয়ে ঘরে ঢুকল। কাজের একটি বার-তের বছরের মেয়ে ছিল, তাকে চা বানাবার কথা বলে সে শোবার ঘরের খাটে বসে রইল। তার নিজেরও খেয়াল নেই কখন সে বিছানার ওপর রাখা ক্যাসেট প্লেয়ারটি চালু করেছে। কি একটা হিন্দি গান হচ্ছে। যেখানে ছুপ ছুপ কে এই কথাগুলো বারবার আছে। কাজের মেয়েটি চা এনে জিজ্ঞেস করল, ভাইজান, আইজ হাসপাতালও খাওন নিবেন?
ঠিক তখনই সমস্ত ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা আহসানের কাছে ধরা পড়ল। ক্যাসেটে গান হচ্ছে। চিকন গলায় একটি মেয়ে এবং মোটা গলায় একটি ছেলে খুব রহস্যময় ভঙ্গিতে গাইছে ছুপ ছুপ কে। আহসান ক্যাসেট বন্ধ করল না। ঠাণ্ডা গলায় বলল, জাহানারা, খারাপ খবর আছে। তোর ভাবি মারা গেছে। এই কিছুক্ষণ আগে।
জাহানারা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। আহসান চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, চিনি দিয়ে তো সরবত বানিয়ে ফেলেছিস। এককাপ চা-ও ঠিকমতো বানাতে পারি না। যা নতুন করে বানিয়ে আন।
জাহানারা অবিশ্বাসী গলায় বলল, ভাবি মারা গেছে? কী কন ভাইজান।
হুঁ। ছেলেটা ভালো আছে। ছেলে হয়েছে একটা। বলেছি?
আহসান উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে ক্যাসেটটা বন্ধ করে সহজ গলায় বলল, ভালো করে চা বানিয়ে আন। অনেক রকম ঝামেলা আছে।
জাহানারা প্রায় দৌড়ে গেল রান্নাঘরে। কিছুক্ষণ পর শোনা গেল সে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বডড বিরক্ত লেগেছিল কান্না শুনে। ইচ্ছে করছিল উঠে গিয়ে কড়া একটা ধমক দিতে। ধমক দেওয়া হয় নি। কিছুক্ষণ পর জাহানারা চা নিয়ে এল। সেই চা-ও মুখে দেওয়া যায় নি। আগের বারের মতো চিনি দিয়ে সরবত। গরম করেছে। আগুনের মত। মুখে দিতেই জিব পুড়ে গেল।
আজ এ-বাড়িতেও হয়ত তাই হয়েছে। অবশ্যি কান্নার কোনো শব্দ আসছে না। ভদ্রলোকের পাঁচ মেয়ে। কিছু একটা হলে এরা কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে। ঘন-ঘন ফিট-টিট হবে। আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি গিজগিজ করবে। হৈ-চৈ চেঁচামেচি। মৃত্যু যেমন কুৎসিত, তার পরবর্তী ব্যাপারগুলো তার চেয়েও কুৎসিত।
এ-বাড়িতে কুৎসিত অংশগুলো এখনো শুরু হচ্ছে না। তবে শুরু হতে কতক্ষণ। যেকোনো সময় শুরু হয়ে যাবে। তার আগে একবার গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসা দরকার। এটা হচ্ছে সামাজিকতা। করুণ মুখে খোঁজ-খবর করতে হবে। একবার হাসপাতালে যেতেও হতে পারে।
বসার ঘরের কলিংবেল
বসার ঘরের কলিংবেল টিপতেই অপরিচিত একজন মাঝবয়েসী মহিলা বের হয়ে এলেন। বিরক্ত মুখে বললেন, কারে চান?
করিম সাহেবের মেয়েরা কেউ আছে?
কোন মেয়েরে চান?
বড় মেয়ে কিংবা অন্য কেউ।
আপনে কে?
আমি তিনতলায় থাকি। ইনাদের ভাড়াটে। আমার নাম আহসান।
আচ্ছা। বুঝেছি। বসেন।
আহসান বসতে-বসতে বলল, করিম সাহেবের খবর নিতে এসেছি। উনার খবর কি? কেমন আছেন এখন?
ভালো না। অবস্থা খুবই খারাপ। আপনে বসেন, বেগমেরে ডাক দেই। ও বেগম, বেগম।
এই যুগে মেয়েদের নাম কেউ বেগম রাখে? কি অদ্ভুত নাম এ-বাড়ির মেয়েদের বেগম, শাহাজাদী, মহল। মহল হচ্ছে তিন নম্বর মেয়েটি। এই মেয়েটি বড় দুবোনের মতোনয়। একটু অন্যরকম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে দেখা হয়ে গেলে বড় দুববানের মতো শক্ত হয়ে যায় না। বরং হাসি-হাসি মুখে তাকায়। মাঝে-মধ্যে দু- একটা কথা-কথাও হয়। যেমন, আহসান যদি বলে, কি ভালো? সে লাজুক স্বরে বলে, দ্ধি।