মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এখন আর পিছনে-পিছনে আসছে না। মেয়েটি একা-একা কোথায় যাবে? আহসান ঠাণ্ডা গলায় বলল,
বাড়ি চলে যাও। আমার পিছনে-পিছনে এসে লাভ হবে না। বাড়ি যেতে পারবে না একা-একা?
মেয়েটি জবাব দিল না।
বাসা কোথায় তোমার?
কল্যাণপুর।
রিকশা এখন পাবে না। যাবে কীভাবে?
মেয়েটি উল্টোদিকে ফিরে হাঁটতে শুরু করল।
এ্যাই শোন। এ্যাই।
মেয়েটি ফিরল না। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। যাক যেখানে ইচ্ছে। আহসান হাঁটতে শুরু করল। ঠাণ্ডায় গা কাঁপছে, নিৰ্ঘাৎ জ্বর আসবে। বাড়ির গেট পর্যন্ত এসে একবার পিছনে তাকাল।
বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুতের আলোয় দেখা যাচ্ছে মেয়েটি রাস্তার একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে হয়ত ভাবছে এই লোকটি আবার তাকে ডাকতে আসবে। কিংবা একা-একা ফিরে যেতে সে ভয় পাচ্ছে।
আহসান তাকে সত্যি-সত্যি ডাকল। কেন ডাকল তা সে নিজেই জানে না। এই মেয়েটির গলার স্বর তারিনের মতো শুধু এই কারণে, নাকি সে ঝড়-বৃষ্টির রাতে নারী কামনা করছে?
তারিনের শাড়ি মেয়েটিকে পরতে দেওয়া উচিত হয় নি। খুব অন্যায় হয়েছে। অন্যায়ের ব্যাপারটা অনেকটা চেইন রিএকশনের মতো একটি অন্যায় করলেই পরপর অনেকগুলো করতে হয়।
মেয়েটি বৃষ্টিতে ভিজছিল, এত রাতে কোথায় কীভাবে যাবে, শুধু এই ভেবেই কি আহসান তাকে ডেকেছে? তার অবচেতন মনে কি অন্য কিছু লুকিয়ে আছে? থাকাটাই কী স্বাভাবিক নয়? এই নিৰ্জন বাড়ি, বৃষ্টির রাত, সুশ্রী চেহারার একটি মেয়ে, আহসানের মাথা ধরে গেল।
ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলে, যাবার জায়গা নেই এইজন্যেই তোমাকে এনেছি। অন্য কিছু নয়।
মেয়েটি কিছু বলল না। কিন্তু আহসানের মনে হল মেয়েটি ঠোঁটের ফাঁকে একটু যেন হাসল। আহসানের কথা ঠিক বিশ্বাস করল না। শুধু কি এই মেয়ে? আহসান নিজেও কী নিজের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে? তারিনের হালকা সবুজ শাড়িতে মেয়েটিকে সত্যি-সত্যি চমৎকার লাগছে। কত বয়স হবে মেয়েটির? আঠার, উনিশ নাকি তার চেয়েও কম? তারুণ্যের আভা চোখে-মুখে। চোখের কোলে অবশ্যি কালি পড়েছে। তাতে আরো চমৎকার লাগছে। মেয়েটি কী মনে করে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল। এটা সে কেন করল কে জানে। এখন বউ-বউ একটা ভাব মেয়েটির মধ্যে চলে এসেছে। বউ মানেই তো কোমল একটা ব্যাপার। স্বপ্ন এবং কল্পনা মেশানো ছবি।
আহসান বলল, আমি এখন ভাত খাব। তুমি কি খাবে?
না।
খেতে চাইলে খেতে পার। রাতে খেয়েছ কিছু?
না।
তাহলে খাবে না কেন?
মেয়েটি কিছু বলল না। আহসানের দিকে তাকিয়ে ঠোট টিপে হাসল। ভালো লাগল দেখতে। কিন্তু এই হাসি তৈরি হাসি। মানুষ ভোলানো হাসি। যেকোনো পুরুষের কাছে গিয়েই এই মেয়ে এমন সুন্দর করে হাসে। তা-ই নিয়ম।
তুমি এমন ঠোট টিপে হাসছ কেন?
মেয়েটি জবাব দিল না। কৌতূহলী চোখে চারদিকে দেখতে লাগল। তার দৃষ্টি আটকে গেল পড়ার টেবিলে রাখা চীনামাটির পুতুলটির ওপর। তারিনের পুতুল। বিয়ের পর সে অল্প যে-সব জিনিস বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে এটি তার একটি। তারিনের খুব শখের জিনিস।
ভাত-তরকারি ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাবার মতো হয়ে আছে। আহসান কেরোসিনের চুলা ধরাল। গরম না-করে কিছু মুখে দেওয়া যাবে না। মেয়েটি পিছনে-পিছনে এসেছে, দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
এই বাড়িতে আর কেউ থাকে না?
প্রশ্নটি সে করল এমনভাবে যেন জবাবের জন্যে তার কোনো আগ্রহ নেই। আহসান। ঠাণ্ডা গলায় বলল, না।
রান্না করে কে?
একটা কাজের মেয়ে আছে। সে রান্না করে দিয়ে যায়। আমি এখানে শুধু রাতে খাই। দিনে বাইরে খাই। হোটেল-টোটেলে খেয়ে নিই।
এতগুলো কথা মেয়েটিকে বলার দরকার ছিল কি কোনো? কোনোই দরকার ছিল না। কিন্তু তবু সে বলেছে। কেন বললঃ
পেটে খিদে থাকলে এস খাও।
মেয়েটি এল। তার সম্ভবত প্রচুর খিদে ছিল। খুব আগ্রহ করে খেতে লাগল। খাবার সময়টায় একবারও আহসানের দিকে তাকাল না। এখনো মাথায় ঘোমটা।
তোমার কি যেন নাম?
পারুল।
আগে তো বলেছিলে রেবা? কোনটা তোমার আসল নাম?
পারুল।
শোন পারুল, তুমি সকাল হলেই এখান থেকে চলে যাবে এবং আর কোনদিন আসবে না।
আচ্ছা।
রোজই কি তুমি রাতে বের হও?
না।
তোমার বাসায় কে-কে আছে?
মেয়েটি জবাব দিল না।
এই যে আজ রাতে বাসায় ফিরলে না। বাসার লোকজন চিন্তা করবে না?
না।
বাসায় তোমার কে-কে আছে?
মেয়েটি জবাব দিল না। একবার শুধু মুখ তুলে তাকাল।
সংসার আছে? অর্থাৎ স্বামী পুত্ৰ কন্যা এরা কেউ?
মেয়েটি উত্তর না দিয়ে থালা হাতে উঠে পড়ল। তার খাওয়া হয়ে গেছে। আহসান বলল, থালা-বাসন ধোয়ার দরকার নেই। সকালে রহিমার মা এসে ঘোবে। রেখে দাও ওখানে।
মেয়েটি রাখল না। অনেকখানি সময় নিয়ে নিজের প্লেট পরিষ্কার করল।
বললাম না এগুলো ধোয়ার দরকার নেই। রেখে দাও। এস আমার সঙ্গে। ঘুমুবার জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটি উঠে এল।
এই ঘরে শোবে। মশারি-টরি সবই আছে। তোমার যদি আগে ঘুম ভাঙে আমাকে ডাকবে। আমি গেট খুলে দেব। বাসায় চলে যাবে।
আচ্ছা।
দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়।
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আপনার আর কিছু লাগবে না?
না লাগবে না। তুমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ কর। নিচে ছিটকিনি আছে। আহ দেরি করছ কেন ছিটকিনি লাগাও।
আপনি কি আমার উপর রাগ করলেন?
না, রাগ করি নি। রাগের কোনো ব্যাপার না। ছিটকিনি দাও। সকালে উঠে চলে যাবে।
ছিটকিনি পড়ার শব্দ হল।
জালাল মিয়া ট্রাক নিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে। একটু আগে ট্রাকের শব্দ পাওয়া গিয়েছিল এখন কোলাপসিবল গেটের তালা খোলার শব্দ আসছে।