বুঝলেন সাহেব, ঐরকম একজনের পাল্লায় পড়েছিলাম। রাত দশটার মতো। বাজে। আমার ভায়রার বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি ঝিকাতলা। একটু ভেতরের দিকে। রিকশা ছেড়ে দিয়ে হাঁটছি, তখন এই মেয়েটা এসে উপস্থিত। নরম গলায় বলল,
আজ রাতটা কি আপনি আমাকে থাকতে দিতে পারেন?
আমি তো বুঝতেই পারি নাই রে ভাই। কচি চেহারা, ভদ্ৰ সাজ-পোশাক।
আপনি কী বললেন?
আমি বললাম, কী অসুবিধা তোমার?
জিওগ্রাফির মনসুর সাহেব চাপা হাসি হেসে বললেন, মা বলে ডাকলেন না? আপনার তো আবার মেয়েদের মা ডাকার একটা প্রবণতা আছে।
নামা ডাকি নি। কলেজের মেয়েগুলিকে মা বলি। বাইরে বলি না। তারপর কি হল শোনেন—আমি বললাম, কী অসুবিধা তোমার? … সে বলল, অনেক অসুবিধা। বলেই হাসল, তখনই ব্যাপারটা বুঝলাম।
কি করলেন?
পাঁচটা টাকা দিলাম। টাকাটা নিল না। তখনই বুঝলাম ভালো ফ্যামিলির মেয়ে, ছ্যাচড়া ধরনের হলে নিত।
মনসুর সাহেব বাঁকা হাসি হেসে বললেন, আপনার মনের অবস্থাটা তখন কী হল বলুন।
কী আবার হবে। কিছু হয় নি-একটু স্যাড ফিল করেছি।
শুধুই স্যাড আর কিছু না? একবারের জন্যেও কি মনে হয় নি এই মেয়েটির সঙ্গে কিছু সময় কাটালে কি আর এমন ক্ষতি হবে? ঘরে ফিরলে সেই তো বাসি স্ত্রী। অর্থের বিনিময়ে টাটকা একজন তরুণীর সঙ্গ মন্দ কি?
কী-সব বাজে কথা বলছেন মনসুর সাহেব?
বাজে কথা একেবারেই বলছি না। নিতান্ত সত্যি-সত্যি কথাটা বলছি। হার্ড টুথ।
নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করবেন না।
নিজেকে দিয়ে বিচার করছি না আপনাকে দিয়েই আমি আপনাকে বিচার করছি। এই যে মেয়েগুলিকে আপনি মা মা ডাকেন, তার পিছনে কি অন্য কিছু কাজ করে না? মা বলে সহজেই একজনের পিঠে হাত রাখতে পারছেন। স্পর্শের আনন্দটুকুর জন্যে আপনি মা ডাকছেন। আমি খুব ভুল বলছি?
ইসমাইল সাহেব স্যান্ডেল খুলে মনসুর সাহেবকে মারতে গেলেন। কেলেঙ্কারি ব্যাপার। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল পর্যন্ত জিনিসটা গড়াল। প্রিন্সিপ্যাল দার্শনিকের মতো বললেন, মেয়েমানুষ কী জিনিস দেখলেন। সামান্য মেয়েমানুষের কথা থেকে স্যান্ডেল নিয়ে ছোটাছুটি। এই খবর বাইরে লিক হলে টিচার্স ক্যুনিটি হিসাবে আমাদের স্থান কোথায় হবে বলেন দেখি? আপনাদের মতো হাইলি এড়ুকেটেড লোক যদি ……
বৃষ্টি এবার বড় বড় ফোঁটায় পড়তে শুরু করেছে। আহসান তার পাউরুটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ভেজা পাউরুটি নিয়ে ঘরে ফেরার কোন অর্থ হয় না। মেয়েটিকে পাউরুটিটা দিয়ে দিলে কেমন হয়? চিন্তাটা মাথায় আসায় আহসান অস্বস্তি বোধ করছে। হঠাৎ একটা পাউরুটি দেওয়ার কথা তার মনে হল কেন? কেন সে পাউরুটি দিতে চাচ্ছে?
মেয়েটি অন্ধকারে হাতড়ে-হাতড়ে কী যেন খুজছে। তার মধ্যে একধরনের ব্যাকুলতা। কিছু বলবে না বলবে না ভেবেও আহসান বলল, কি খুঁজছ? বলেই সে নিজে চমকে উঠল। সে কি খুঁজছে না খুঁজছে তা নিয়ে আহসানের মাথাব্যথা কেন?
মেয়েটি খোঁজা বন্ধ করে আহসানকে দেখছে। জায়গাটা অন্ধকার, সে নিশ্চয়ই কিছু দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটি নিচু গলায় বলল, আমার স্যান্ডেল খুঁজতেছি।
তুমি কি এই দিকে থাক?
না।
কোথায় থাক?
মেয়েটি জবাব দিল না। ধুম বৃষ্টি চলছে। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানে হয় না। কিন্তু সে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যাতে মনে হতে পারে সে অপেক্ষা করছে। মেয়েটির জন্যে।
স্যান্ডেল পাওয়া গেছে?
না।
নাম কি তোমার?
রেবা।
এটা নিশ্চয়ই ছদ্মনাম। আসল নাম অন্য কিছু। ঠিক নামটি এরা ্কখনো বলে না।
এটা তোমার ঠিক নাম?
না।
আহসান পা বাড়াল। আশ্চর্য মেয়েটিও আসছে। আহসান থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শীতল গলায় বলল, আমার সঙ্গে-সঙ্গে আছ কেন?
মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আবার হাঁটতে শুরু করল, আহসানের পাশে পাশে আসছে। দু জন মানুষ পাশাপাশি হাঁটছে অথচ কেউ কোনো কথা বলছে না। জায়গায়জায়গায় পানি জমে আছে। পা পড়তেই ছপ-ছপ শব্দ হচ্ছে। চারদিকে ব্যাঙ ডাকছে। জায়গাটা পুরোপুরি গ্রামের মতো হয়ে গেছে। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে নিকষ অন্ধকার। তারিনকে নিয়ে একবার ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে আঠারবাড়ি স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে কুতুবপুর যেতে হয়েছিল। কি ফুর্তি তার। আহসান বার বার বলছিল, হাত ধরে হাঁট, পিছলে পড়বে।
তারিন হাসতে-হাসতে বলেছে, পিছলে পড়লে একা পড়ব। তোমার হাত ধরে থাকলে তুমিও পড়বে। দু জন পড়লে লাভ কি বল? তার কথা শেষ হবার আগেই আহসান নিজে পিছলে পড়ল। তারিনের হাসি আর থামেই না।
আহ কী করছ? লোকজন জড়ো হবে।
হোক জড়ো। হাসার সময় হাসব। কাঁদার সময় কাঁদব।
সত্যি-সত্যি। তারিনের হাসিতে লোকজন এসে পড়ল। তারা কিছুতেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে যেতে দেবে না। তারিন যাবেই। শেষ পর্যন্ত একদল লোক সঙ্গে নিয়ে রওনা হতে হল। একজন একটি ছাতা ধরে থাকল তারিনের মাথায় একটা ট-লাইটও যোগাড় হয়েছিল। টর্চলাইটধারী আগে-আগে আলো ফেলতে লাগল। তারিনের আনন্দ পুরোপুরি মাঠে মারা গেল। এইসব যেন অন্য কোন জন্মের কথা। এই জন্মের নয়। এই জন্মে লম্বা রোগা একটি মেয়ে তার সঙ্গে-সঙ্গে আসছে। তার একহাতে একটিমাত্র স্যাভেল অন্য স্যান্ডেলটি সে খুঁজে পায় নি। হয়ত দিনের বেলা গিয়ে খুঁজবে। সেইজন্যেই এটি সে সঙ্গে করে আনছে।
এই মেয়ে?
হুঁ। তুমি আমার সঙ্গে-সঙ্গে আসছ কেন? স্টপ। আসবে না। যত বাজে ঝামেলা। বাড়ি যাও।
এই জাতীয় মেয়েরা কত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকে কে জানে। এরা কি একা-একাই বাড়ি ফেরে, না কেউ এসে নিয়ে যায়? হয়ত বাড়ি থেকে কেউ এসে নিয়ে যায়। কিংবা কোনো রিকশাওয়ালার সঙ্গে ঠিকঠাক করা থাকে। এরা এসে বাড়ি নিয়ে যায়। আজ ঝড়-বৃষ্টির জন্যে কেউ আসে নি।