জানি না।
লোকটি মুখ আরো বিরস করে ফেলল। পাগলা কুকুর কেন, বাঘ বেরুলেও তার কিছু যায়-আসে না।
আহসানের ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। একবার ঘরে ঢুকলে বেরুতে ইচ্ছে করে না, আবার বেরুলে ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। অদ্ভুত অবস্থা। সকালে নাশতার কিছু নেই। নূর বেকারি খোলা। সে কলা এবং রুটি কিনল।
আজ সকালে ঘরে নাশতার কিছু ছিল না বলে, না খেয়ে কলেজে ছুটতে হয়েছে। দুটি দেয়াশলাই কিনে টাকা দেবার সময় মনে পড়ল ড্রয়ারে পুরো এক প্যাকেট দেয়াশলাই দেখে এসেছে। কোন জিনিস আছে কোন জিনিস নেই তার কোনো হিসাব থাকছে না। যা নেই তা কেনা হচ্ছে না। যেটা আছে সেটাই কেনা হচ্ছে। হয়ত ঘরে গিয়ে দেখবে পাউরুটিও একটি পড়ে আছে।
নূর বেকারির ছেলেটিকে দেখে মনে হচ্ছে আলাপী। আহসান অন্তরঙ্গ সুর বের করল, একটা নাকি পাগলা কুকুর বের হয়েছে, জান কিছু?
ছেলেটি জবাব দিল না। রাগী চোখে তাকাল। তুমি করে বলায় হয়ত রক্ত গরম হয়ে গেছে। মাস্টারি করে এই সমস্যা হয়েছে—সবাইকে ছাত্র মনে হয়।
খিদে জানান দিচ্ছে। আহসান খিদে-পেটেই সিগারেট ধরাল, ঠিক তখন। হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি নামল। ধুম বৃষ্টি। এ-বৃষ্টি থামবে না। ধরন দেখেই বলে দেওয়া যায় সারা রাত চলবে। দৌড়ে কোথাও দাঁড়ানোর কোনো মানে হয় না। শেষ পর্যন্ত কাকভেজা হয়েই বাসায় ফিরতে হবে। তবুবৃষ্টি নামলেই কোথাও দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। আহসান ছুটে গিয়ে দাঁড়াল মেসার্স রহমানিয়ার বারান্দায়। মাথার ওপর খানিকটা ছাদের মতো আছে। তাতে বৃষ্টি আটকাচ্ছে না। আশ্রয়ের খোঁজে আরো কিছু লোকজন এসেছে। একজন ভিখিরি, সঙ্গে ইদুরের বাচ্চার মতো কৃশ একটি বাচ্চা। বাচ্চাটি গভীর রাতেও জেগে আছে। চোখ বড়-বড় করে তাকাচ্ছে। একজন বুড়ো লোক যাকে প্রথম দৃষ্টিতে ভিখিরি মনে হলেও সে ভিখিরি নয়। কারণ তার হাতে একটি বাজারের থলে আছে। সেই থলের ভেতর থেকে লাউয়ের মাথা বের হয়ে আছে। ভিখিরির কাছে বাজারের থলে থাকে না। এই বুড়ো গভীর রাতে বাজার করে কোথায় ফিরছে কে জানে। একেকবার বৃষ্টির ঝাপটা আসছে আর এই বুড়ো করে থুথু ফেলছে।
কোণের দিকে প্রায় দেয়াল ঘেঁষে লম্বা রোগা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত ঐদিনকার সেই মেয়েটি। মেয়েটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে আলো নেই, মুখ দেখা যাচ্ছে না। মুখ দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে আবার হচ্ছেও না। থলে হাতে বুড়োটি মেয়েটির দিকে কয়েকবার তাকিয়ে ঝাঁজালোভাবে কিসব বলল। আহসান শুনতে পেল না। ভিখিরি মেয়েটি শুনল এবং হাসতে-হাসতে ভেঙে পড়ার মতো হল। ভিখিরির শিশুটি হয়ত তার মা হাসি শুনে অভ্যস্ত নয়। সে কেঁদে উঠল। ভিখিরিটির হাসি আর থামেই না। আহসানের বুকে ছোট্ট একটি ধাক্কা লাগল। তারিনের হাসির সঙ্গে এই মেয়েটির হাসির মধ্যে কোথায় যেন একটি মিল আছে। ধ্বনির মিল—যা মাথায় ঢুকে ঝন-ঝন করে বাজে। কেন জানি হাসি শুনতে ইচ্ছে করছে না। আহসান বৃষ্টি মাথায় করেই রাস্তায় নামল। আশ্চর্যের ব্যাপার, লম্বা মেয়েটিও তার সঙ্গে-সঙ্গে নেমে আসছে। আজ বোধ হয় বেচারীর ভাগ্যে কিছু জোটে নি।
একজনের সঙ্গে অন্য একজনের মিলের ব্যাপারটা বোধ হয় মনগড়া। আসলে তেমন কোনো মিল থাকে না। মিল কল্পনা করা হয়। আমরা একজনের চোখে অন্য একজনের ছায়া দেখি। একজনের চুল অন্য একজনের চুলের কথা মনে করিয়ে দেয়। তারিনের মৃত্যুর পরপর এই ব্যাপারে খুব ঘটত। হয়ত একটা মেয়ে রিকশা করে যাচ্ছে। হুড তোলা হয় নি, বাতাসে মেয়েটির চুল উড়ছে। সাধারণ দৃশ্য। তবুবুকের মধ্যে ধক করে উঠবে আরে এই মেয়েটি তো তারিনের মতো। রিকশা চলে না-যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকতে হবে। বুকের কোন গহীন গোপনে ব্যথা ছলছলিয়ে উঠবে।
একবার ক্লাসে এরকম হল। সেকেন্ড ইয়ার অনার্স ক্লাস। এসথেটিকস পড়ানো হবে। রোল কল করা হচ্ছে। রোল ফিফটি এইট বলা মাত্র একটি মেয়ে বলল, প্রেজেন্ট স্যার। আহসান হতভম্ব! আরে এর গলা তো অবিকল তারিনের গলার মতো।
আহসান সেই স্বর দ্বিতীয় বার শোনার জন্যে আবার বলল, রোল ফিফটি এইট।
প্রেজেন্ট স্যার।
আবার শুনতে ইচ্ছে করছে। একটা রোল তিনবার ডাকা যায় না। আহসান বলল, রোল ফিফটি এইট তুমি এত এ্যাসেন্ট থাক কেন?
স্যার, আমি তো এ্যাবসেন্ট থাকি না।
ও আচ্ছা। আমার ভুল হয়েছে—বস।
মেয়েটি বসে পড়ল। সে বেশ বিব্রত বোধ করছে। তার দু পাশের বান্ধবীরা মুখ টিপে হাসছে। একজন সম্ভবত পেনসিল দিয়ে খোঁচাও দিল। এ-কালের মেয়েগুলি ফাজিলের চূড়ান্ত। সহজ কথারও তিন রকম অর্থ করে মজা পায়।
বৃষ্টি যতটা জোরাল মনে হচ্ছিল ততটা জোরাল নয়। কুয়াশার মতো পড়ছে। বাসা পর্যন্ত যেতে মাথা সামান্য ভিজবে, এর বেশি কিছু হবে না। ঝম-ঝম বৃষ্টি হলে মন্দ হত না। অনেকদিন ধুম বৃষ্টিতে ভেজা হয় না।
মেয়েটি আসছে তার পিছনে-পিছনে। স্যাভেল খলে হাতে নিয়েছে, পা ফেলছে খুব সাবধানে। এর বাড়ি বোধ হয় আশেপাশে কোথাও হবে। একা-একা যেতে ভয় পাচ্ছে। বলে সঙ্গে আসছে। আসুক ক্ষতি তো কিছু নেই। এত সাবধানতায়ও কাজ দিল না। মেয়েটি পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে সে যে কাদায় মাখামাখি হয়েছে এটা বোঝা যাচ্ছে। এগিয়ে এসে হাত ধরে তোলার কোনো অর্থ হয় না। আবার পাশ-কেটে চলে যেতেও খারাপ লাগে।
এই জাতীয় মেয়ের সংখ্যা শহরে দ্রুত বাড়ছে। কলেজের ইসমাইল সাহেবের ধারণা শহরটা প্ৰসটিটিউটের শহর হয়ে যাচ্ছে। ইসমাইল সাহেব লোকটি বেশ রসিক। যাই বলেন শুনতে ভালো লাগে।