জায়গাটার আসলেই একটা রহস্য আছে। গন্ধটা এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল। যদি পাওয়া যায়। অপেক্ষাটা বিপজ্জনক-আকাশের অবস্থা বেশ খারাপ। বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে তুমুল বৰ্ষণ হবে। কিন্তু জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কেন মাঝেমাঝে চমৎকার একটা গন্ধ এজায়গাটায় পাওয়া যায়? কারো সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলে হয়। আলাপের জন্যে বিষয়টি অবশ্যি খুবই তুচ্ছ। তবু মাঝে-মাঝে তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছে করে। চার বছর আগে তারিন ছিল। যেকোনো তুচ্ছ জিনিস নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করা যেত তার সঙ্গে। চমৎকার সময় কাটত। একবার তারিন নিউমার্কেটে যাবার পথে দেখল একটা মহিষকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে। সে বাসায় ফিরল দারুণ উত্তেজিত হয়ে।
আজ একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম-মহিষকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে।
আহসান হাই তুলে বলল, এটা অদ্ভুত কিছু না। গরু-মহিষকে প্রায়ই ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যায়। এরা হাঁটতে পারে না বলে এই ব্যবস্থা। তুমি যদি দেখতে একটা বাঘকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে তাহলেও একটা কথা ছিল।
মহিষটা অসুস্থ না, খুবই সুস্থ।
সুস্থ হলে একে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাবে কেন?
তারিন হাসতে-হাসতে বলল, আমি জানি কেন নিয়ে যাচ্ছে। তুমি যদি বলতে পার তাহলে তোমার জন্যে পুরস্কার আছে।
কী পুরস্কার আগে বল।
না—আগে-ভাগে বলা যাবে না।
তুমি যদি একটি বিশেষ পুরস্কার আমাকে দাও তাহলে চেষ্টা করে দেখতে রাজি আছি।
কি অসভ্যতা করছ? ছি।
অসভ্যতা কি করলাম? আমি একটি বিশেষ পুরস্কারের কথা বলছি। এর বেশি। তো কিছু বলি নি।
থাক তোমাকে কিছু বলতে হবে না।
রাগ করে উঠে চলে যায় তারিন। সেই রাগ ভাঙাতে আহসানকে যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়। শেষ পর্যন্ত রাগ ভাঙে এবং আহসান অনুমান করতে চেষ্টা করে কেন মহিষটিকে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে।
মহিষটার একটা পা ছিল খোঁড়া?
হল না।
গাড়ির নিচে পড়ে জখম হয়েছে, হাঁটতে পারছে না তাই—
হল না।
মহিষটা সম্ভবত বিয়ে করতে যাচ্ছে—
ফাজলামি করবে না ঠিকমতো বল।
পারছি না। তুমি বলে দাও।
মহিষটার একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা হাঁটতে পারে না বলে বাচ্চা এবং মা ঠেলাগাড়িতে করে যাচ্ছে। এই সহজ জিনিসটা বলতে পারলে না?
তুমি বলছ মহিষ। মহিষ হচ্ছে পুংলিঙ্গ। ম্যাসকুলিন জেন্ডার। আমি বুঝব কী করে এর একটা বাচ্চা আছে?
মহিষ-এর স্ত্রীলিঙ্গ কী?
মহিষী কিংবা মহিষিনী কিংবা মহিলা মহিষ।
ওমা তুমি জান না নাকি?
না, জানি না।
প্রফেসর মানুষ আর এই সাধারণ জিনিসটা তুমি জান না?
আমি কি বাংলার প্রফেসর নাকি যে জানব? আমি হচ্ছি যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক।
যুক্তিবিদ্যা তো তুমি আরো কম জান।
কী করে বুঝলে?
আমার সঙ্গে তো কোনো যুক্তিতেই তুমি পার না।
অর্থহীন কথা। বলার জন্যেই কথা বলা। এর বেশি কিছু না। কিন্তু কি অপূর্ব ছিল সেই অর্থহীন কথাবার্তা। তারিন যদি আজ থাকত তাহলে নিশ্চয়ই এই হঠাৎ আসা গন্ধের রহস্য বের করে ফেলত। কোনো এক রাতে ঘুমুতে যাবার আগে কৃত্রিম একটা হাই তুলে বলত, গন্ধ-রহস্যের সমাধান হয়েছে।
কী সমাধান?
আজ বলা যাবে না ঘুম পাচ্ছে।
আহ, বল না।
বললাম তো ঘুম পাচ্ছে।
আরেকবার হাই তুলে এমন ভাব করত যাতে মনে হতে পারে সত্যি-সত্যি ঘুম পেয়েছে।
আহসান অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। ছোট ছোট কয়েকটি বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয় না। রাত অনেক হয়েছে। বৃষ্টিবাদলা দেখলে দোকানপাট বন্ধ করে দোকানীরা বাড়ি চলে যাবে। মস্তান ধরনের ছেলেপুলে বোতল হাতে নিরিবিলি জায়গার খোঁজে আসবে এদিক দিয়েই। এটি মোটামুটি নির্জন অঞ্চল। ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে এরকম একটি ঘরে তাদের আসর বসবে।
এ-জাতীয় একটি দলের সামনে একবার আহসান পড়ে গিয়েছিল। রাত বেশি হয়। নি, দশটা-সাড়ে দশটা। পাঁচ-ছটি ছেলের একটা দল একটি মেয়ের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। মেয়েটি যেতে চাচ্ছে না। ল্যাম্প-পোস্টের আলোয় মেয়েটিকে চমৎকার লাগছে। রোগা, লম্বা একটি মেয়ে, কচি মুখ। এসব ক্ষেত্রে কোনোরকম কথা না-বলাই বিচক্ষণতার লক্ষণ। কিন্তু আহসান, অসম্ভব সাহস দেখাল। কড়া গলায় বলল এ্যাই, কী ব্যাপার? কী হচ্ছে?
দলটি থেমে গেল। মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করছে। যে তার হাত ধরে আছে সে চিকন গলায় বলল, আপনি যা ভাবছেন তা না ব্রাদার। ভদ্রঘরের মেয়ে না। ট্রিপ দেওয়া মেয়ে। জায়গায়-জায়গায় ট্রিপ দেয়। একসঙ্গে বেশি কাস্টমার দেখে ঘাবড়ে গেছে।
বলার ভঙ্গিটি এতই কুৎসিত যে গা জ্বালা করে। কিন্তু জ্বালা করা পর্যন্তই। কিছুই করবার নেই। তবে ঐ মেয়েটি আজেবাজে ধরনের মেয়েই ছিল। কারণ আহসান দেখল মেয়েটি বেশ সহজভাবেই যাচ্ছে। তাকে আর আগের মতো টেনে-হিচড়ে নিতে হচ্ছে না। অল্প বয়সের এ-রকম সুশ্রী একটি মেয়ের একি দুর্দশা! মেয়েটি যেতে যেতে একবার বলল, এমুন করেন ক্যান? যাইতেছি তো। সকাল সকাল ছাড়বেন কিন্তুক।
এর উত্তরে ছেলেদের একজন কি বলল ঠিক বোঝা গেল না, তবে নিশ্চয়ই হাসির কিছু মেয়েটি খিল-খিল করে হাসছে। অর্থহীন হাসি।
আহসান দু প্যাকেট সিগারেট কিনল। সবকিছু বেশি-বেশি থাকাই ভালো। সিগারেটওয়ালার মুখে অসম্ভব বিরক্তি। শেষ সময়ে দু প্যাকেট সিগারেট বিক্রি করেও তার বিরক্তি দূর হল না। টাকার ভাংতি হিসাব করছে এই জন্যেই কি বিরক্তি? নাকি তারও খিদে পেয়েছে, বাড়ি যেতে ইচ্ছা করছে; কিন্তু যেতে পারছে না, কারণ বিক্রি ভালো হয় নি। আহসান লোকটির বিরক্তি কমাবার জন্যে হালকা গলায় বলল, একটা পাগলা কুকুর নাকি বেরিয়েছে, জান নাকি?