আপনাকে কিছু দেখতে হবে না। আপনি এখানে খানিকক্ষণ বসুন। বেশিক্ষণ বসতে হবে না। জালাল মিয়া চলে আসবে।
জালাল মিয়া কে? ট্রাকের ড্রাইভার।
ঠিক আছে আমি বসলাম। এত জায়গা থাকতে ভূতটা বাথরুমে গিয়ে বসে আছে। কেন? এই রাতদুপুরে গোসল করার তার কি দরকার পড়ল? বোধ হয় গরম লাগছে।
একটি সহজ এবং সাধারণ রসিকতা। পরিস্থিতি হালকা করার জন্যে এরকম রসিকতা করা যেতে পারে। কিন্তু বড় মেয়েটি এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন খুব আহত হয়েছে। এই সাধারণ রসিকতাটিতে আহত হবার কী আছে? আহসান বলল,
অন্য ভাড়াটেরা কেউ নেই?
জ্বি না।
অন্য ভাড়াটেরা কেউ যে নেই এই তথ্যটি আহসানের জানা। দোতলার বাঁদিকের ভাড়াটে আসিক সাহেব তাঁর স্ত্রীকে দেশের বাড়িতে রেখে আসতে গিয়েছেন। ডানদিকের ভাড়াটে বজলু সাহেব গত সপ্তাহে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। বজলু সাহেবকে আহসানের সবসময় ভালোমানুষ বলে মনে হত। কিন্তু লোকটি চলে যাবার পর জানা গেল সে বাথরুমের কমোড ভেঙে দু টুকরা করেছে। একটি আয়না এবং রান্নাঘরের বেসিন ভেঙেছে। শোবার ঘরের জানালার সব কটি কাচ ভেঙেছে। এই কাজগুলো তাকে বেশ পরিশ্রম করে করতে হয়েছে বলাই বাহুল্য।
করিম সাহেব আহসানকে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সব দেখালেন। তার মনে হল রাগের বদলে ভদ্রলোকের বিস্ময়টাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। বার-বার বলছেন, এরকম কেন করল বলেন তো?
বলা মুশকিল। আপনার ওপর হয়ত রাগ আছে।
রাগ থাকবে কেন? আমাকে সবসময় চাচা-চাচা বলত। যাবার সময় পা ছুঁয়ে সালাম করল। আমি পনের দিনের ভাড়া নিই নাই।
দুনিয়ায় অনেক রকমের মানুষ আছে।
আমাকে ক্ষতি করিয়ে তার লাভ কি হল? ক্ষতি করেছে এইটাই লাভ।
যদি কোনোদিন দেখা হয় আপনার সঙ্গে, তাহলে কথাটা জিজ্ঞেস করবেন? বলবেন-আমি মনে কষ্ট পেয়েছি। খুব কষ্ট।
দেখা হলে বলব। দেখা হবে না। এই জাতীয় লোকদের সঙ্গে দেখা হয় না।
তাও ঠিক। কি সমস্যায় পড়েছি বলেন তো দেখি। বাড়ি ঠিকঠাক না-করে ভাড়াও দিতে পারব না। ইংলিশ কমোড আর বেসিন ছিল। শখ করে কিনেছিলাম। আগে জানলে বাংলাদেশিটা কিনতাম।
আহসান সিগারেট ধরাল। খালি পেটে সিগারেট টানতে ভালো লাগছে না। মুখ বন্ধ করে বারান্দায় বসে থাকাও বিরক্তিকর। বড় মেয়েটি এখন আবার কাঁদতে শুরু করেছে। কাঁদছে নিঃশব্দে। এবং খুব চেষ্টা করছে নিজেকে আড়াল করে রাখতে। ছোট মেয়ে দুটি বোনের গা ঘেঁষে বসে আছে এবং এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। এদের ভাব-ভঙ্গি থেকে মনে হচ্ছে এরাও কাঁদতে শুরু করবে। আহসানের কারণে সংকোচ বোধ করছে বলে কাঁদছে না।
রাস্তায় ট্রাকের আলো দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত জালাল মিয়া ট্রাক নিয়ে আসছে। মেয়ে তিনটি উঠে দাঁড়িয়েছে। গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে। বড় মেয়েটি বলল, আপনি এখন যেতে পারেন, জালাল এসেছে।
আহসান নিজের ঘরে চলে এল। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় মনে হল—জালাল কী খবর আনল জানা দরকার ছিল। অতি সাধারণ ভদ্রতা। কেন জানি ভদ্রতাটা করা হল না। মেয়েদের সঙ্গে আলাপে সে করিম সাহেবের প্রসঙ্গ আনে নি। এটাও অন্যায় হয়েছে। খুবই অন্যায়। এ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে হল এইসব জিজ্ঞেস করা দরকার ছিল।
দরজায় খুট-খুট শব্দে টোকা পড়ছে। আহসান দরজা খুলল, জালাল মিয়া দাঁড়িয়ে আছে।
বিরক্ত করলাম প্রবেসার সাব।
না-বিরক্তের কিছু না। উনার খবর কি?
খবর খারাপ। মেয়েগুলিরে নিতে আসছি। রাতে আর ফিরব না। আপনারে বলে গেলাম। একটু লক্ষ রাখবেন।
রাখব, লক্ষ রাখব।
যা মুশকিলে পড়লাম ভাইজান—মেয়েগুলি খুব কানতেছে। আচ্ছা যাই। আপনার কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা দেন।
প্যাকেটে দুটি সিগারেট ছিল। আহসান প্যাকেটটাই হাতে তুলে দিল।
বিপদের উপরে বিপদ বুঝলেন বেসার সাব। আমার হেল্লার ব্যাটারে কুত্তায় কামড় দিছে। পনরখান ইনজিকশন লাগে। কি সমস্যা চিন্তা করেন দেহি।
সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়ে দেওয়া ভুল হয়েছে। আহসানের ধারণা ছিল ড্রয়ারে একটা নতুন প্যাকেট আছে, এখন দেখা যাচ্ছে নতুন প্যাকেট নেই। পুরনো চিঠি-পত্ৰ, একটা মোমবাতি, এক প্যাকেট নতুন দেয়াশলাই ছাড়া ড্রয়ার পুরোপুরি শূন্য। রাত বাজছে এগারটা পঁচিশ। সিগারেটের জন্যে হেঁটে-হেঁটে রাস্তার মোড় পর্যন্ত যেতে হবে। প্রায় বিশ মিনিটের পথ। যে পাগলা কুকুর ড্রাইভারের হেপ্পারকে কামড়েছে সে নিশ্চয়ই এই অঞ্চলেরই বাসিন্দা।
সুযোগ পেলে তাকেও কামড়াবে। পাগলা কুকুরের নিয়ম হচ্ছে সাত জনকে কামড়ানো। তারিন তাই বলত। অদ্ভুত-অদ্ভুত সব তথ্য তারিনের মাথায়। বিড়াল নাকি চোখ ফোটার আগে তার বাচ্চাকে সাত বাড়ি ঘুরিয়ে আনে। জোড় বাচ্চা রাখে না। যে বিড়ালের চারটা বাচ্চা সে একটাকে মেরে সংখ্যা বিজোড় করে ফেলে। কোত্থেকে সে এইসব যোগাড় করত কে জানে?
খিদে লেগেছে। ভাত খাবার পর একটা সিগারেট খাওয়া যাবে না—এই চিন্তাটি তাকে অস্থির করে তুলল। আকাশের অবস্থাও ভালো না। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টির সময়। অথচ যেতে হবে ছাতা ছাড়া। প্রতি বর্ষাতেই তাকে একটি করে ছাতা কিনতে হয়। এবারের ছাতাটি সে গত সপ্তাহে কিনেছে। একদিন মাত্র ব্যবহার করেছে। তারপরই ছাতা নিখোঁজ। আরেকটি কিনতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই বৰ্ষা ভিজেই কাটুক। আহসান খুলে ফেলা জুতো আবার পরতে বসল, সিগারেট না আনলেই নয়। নেশার জিনিস ফুরিয়ে গেলে খুব অস্থির লাগে।