কোনো বাবা নিজের মেয়েদের নিয়ে এ জাতীয় কথা বলতে পারে তা আহসানের ধারণার বাইরে ছিল। এই লোক বলে।
ভদ্রলোকের কথাবার্তার ভঙ্গি থেকে আহসানের মাঝে-মাঝে মনে হয় তাকে নিয়ে ভদ্রলোকের তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। থাকলে মেয়েদের সম্পর্কে এ জাতীয় কথাবার্তা বলতেন না। তাছাড়া খেতে যখন ডাকেন তখনও মেয়েরা কেউ আসে না বা উকি-ঝুকি দেয় না। তাঁর বাড়ির পর্দা প্রথাটি বেশ কঠিন। মেয়েগুলো নিউমার্কেটে যায় বোরা পরে।
আহসানের বাসা তিনতলার ডানদিকে। বাঁদিকটা খালি। দরজা-জানালা এখনো লাগানো হয় নি। আহসানের বাসাও পুরোপুরি তৈরি হয় নি। চুনকাম বাকি আছে। দরজায় রঙ লাগানো হয় নি। তিনটি রুমের একটিতে এখনো দরজা-জানালা লাগানো বাকি। সেকারণেই ভাড়া কমতের শ টাকা। গ্যাস-ইলেকট্রিসিটি সবই এর মধ্যে। তবে গ্যাস লাইন এখনো বসে নি বলে এই সুবিধাটি পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে সুযোগ পেলেই করিম সাহেব এই কথা শুনিয়ে দেন
কয়েকটা দিন অপেক্ষা করেন। গ্যাস লাইন বসলে কত আরাম হবে দেখেন। এক পয়সা বাড়ি ভাড়া বাড়াব না। ভদ্রলোকের এক জবান। এত সস্তায় ঢাকা শহরে আর বাড়ি নাই। কী রকম আলো-হাওয়া, দেখতেছেন? ভাদ্র মাসেও ফ্যান ছাড়তে হয় না। দক্ষিণমুখী বাড়ি।
বাড়ি দক্ষিণমুখী খুবই ঠিক কথা। আলোহাওয়াও প্রচুর অস্বীকার করার উপায় নেই; তবে তিনতলায় যেতে হয় বাড়িওয়ালার ঘরের ভেতর দিয়ে। বাইরে সিঁড়ি নেই। ভাড়া দেওয়ার জন্যে যে বাড়ি বানায় সে কখনো এমন অদ্ভুত ব্যবস্থা রাখে? কিন্তু করিম সাহেব রেখেছেন। এবং তাঁর কথায় মনে হয় তিনি এটা রেখেছেন ইচ্ছা করেই।
বাইরে সিঁড়ি থাকলে চুরি-চামারির সুবিধা। হুট করে চেনা-অচেনা লোক ঢুকে পড়বে। এখন সেটা পারবে না। সব থাকবে চোখে-চোখে। রাতের বেলা কলাপসেবল গেট বন্ধ করলে একেবারে নিশ্চিন্ত। দরজা-জানালা খোলা রেখে নাক ডাকিয়ে ঘুমান। কোনো অসুবিধা নাই।
আসতে-যেতে বারবার বিরক্ত করতে হয় আপনাদের।
বিরক্ত করতে হলে করবেন। পয়সা দিচ্ছেন বিরক্ত করবেন না? মাগনা থাকলে একটা কথা ছিল। আর পরের বাড়ি মনে করেন কেন? নিজের বাড়ি মনে করবেন। একদম নিজের বাড়ি।
করিম সাহেবের এই বাড়িটিকে নিজের বাড়ি মনে করার কোনোই কারণ আহসানের ঘটে নি। এই পরিবারের অন্য কারোর সঙ্গে তার সামান্যতম পরিচয়ও নেই। তাঁর স্ত্রীকে সে এখনো চোখে দেখে নি। অথচ সে দুমাসের ওপর এ-বাড়িতে আছে। তাঁর বড় তিনটি মেয়ের সঙ্গে হঠাৎ-হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, তবে তখন তারা এমন চমকে ওঠে যে আহসানের নিজেরই অস্বস্তি লাগে। মেয়ে তিনটি দেখা হলেই বিদ্যুতের মত মাথা ঘুরিয়ে নেয়। মহা বিরক্তির ব্যাপার। ছোটো দুটি এরকম না করলেও রোবটের মতো গলায় বলে—আসোলামু আলায়কুমসেটা আরো বিরক্তিকর। সালাম দেওয়ার অদ্ভুত কায়দা তারা কোথায় শিখেছে কে জানে!
করিম সাহেবের বারান্দায় আজ বাতি জ্বলছে। বারান্দায় সাত-আটটি চেয়ার পাতা। তাঁর বড় মেয়েটি ছোট দুটি বোনকে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে। আহসানকে দেখে এরা তিনজনই উঠে দাঁড়াল। যেন তারা আহসানের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। এই প্রথম বার ছোট মেয়ে দুটি আসোলামু আলায়কুম বলল না। বড় মেয়েটিও মাথা ঘুরিয়ে মূর্তির মতো হয়ে গেল না। আহসান কি করবে ভেবে পেল না। দাঁড়াবে খানিকক্ষণ? করিম সাহেবের ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেবে নাকি সরাসরি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবে ওপরে? সে সবচেয়ে ছোট মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার আৰ্ব এখন কেমন আছেন?
জানি না।
দেখতে যাও নি?
সবাই গেছে। আমরা তিন জন শুধু আছি।
তোমরা যাও নি কেন?
মেয়েটি এই প্রশ্নের জবাব দিল না। কাল বড় বোনের দিকে। বড় মেয়েটি বলল, আপনি এখানে একটু বসুন।
মেয়েটির গলার স্বর ঠাণ্ডা এবং কোমল। উচ্চারণ স্পষ্ট। বাবার মতো আঞ্চলিক সুর নেই; যদিও একটু টেনে-টেনে কথা বলছে। তার কথা বলার মধ্যে কোনো জড়তাও নেই। তাকিয়েও আছে সরাসরি আহসানের দিকে। সুন্দর চেহারা। বেশ ফর্সা—একটা স্নিগ্ধ ভাব আছে। সম্ভবত অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছে। চোখ-মুখ ফোলাফোলা, সেই কারণেই কি একটা আদুরে ভাব চলে এসেছে? করিম সাহেবের কথা অনুসারে এই মেয়েটিও টাকা চুরি করে এবং নিজের ট্রাংকে গোপনে জমায়। মেয়েটিকে দেখে এটা ভাবতে বেশ কষ্ট হয়।
আমাকে বসতে বলছ?
জ্বি। আপনি একটু বসুন। আমাদের ভয় লাগছে।
কীসের ভয়?
বাথরুমে অনেকক্ষণ ধরে কি যেন শব্দ করছে।
ইঁদুর-টিদুর হবে বোধ হয়। জ্বি না।
ইঁদুর না। অন্য কিছু।
অন্য কিছু কী?
বড় মেয়েটি তার জবাব দিল না। ছোট মেয়ে দুটি এ ওর দিকে তাকাতে লাগল। এদের কারোর নামই আহসানের জানা নেই। সবার নামই একই ধরনের। পাঁচটি একধরনের নাম মনে রাখা কষ্ট। আহসান বলল,
চোর-টোর নাকি?
বড় মেয়েটি বলল, জ্বি না, চোর না। সাদা কাপড় পরা একজন কে যেন বাথরুমে। ঢুকল। আমি বাথরুমে গিয়ে দেখি কিছু নেই।
ভূত-প্ৰেত?
মেয়েটি জবাব দিল না। আহসান বলল, বাবার ব্যাপারে তোমাদের মন দুর্বল হয়ে আছে, তাই এইসব দেখেছ। ঢাকা শহরে অনেক কিছুই আছেভূত নেই।
আমি এই সাদা কাপড় পরা মেয়েটাকে আগেও একদিন দেখেছি, ছাদে বসেছিল।
বল কী তুমি?
মেয়ে তিনটি ভূতের ভয়েই মুখ শুকনো করে বসে আছে। বাবার অসুখের চেয়ে এই ভয়টিই বর্তমানে তাদের কাবু করেছে। ঠিক এই মুহূর্তে তারা সম্ভবত বাবার কথা ভাবছে না! আহসান বসল, ঠিক তখন সত্যি-সত্যি খটখট শব্দ শোনা গেল ভেতর থেকে। দারুণ চমকে উঠল মেয়ে তিনটি। আহসান বলল, চল দেখে আসি।