জ্বি স্যার।
তোমার রিকশার জমার টাইম হয়ে গেছে বোধ হয়।
জ্বি স্যার।
যাও তাহলে আর দেরি করবে না। দেরি করলে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়ে যাবে।
রিকশাওয়ালা থেমে থেমে বলল, আপনে আমার ছেলেপুলে কয়জন জিগাইছিলেন–আমার দুই পুলা।
ভালো, খুব ভালো।
বড় পুলারে ইস্কুলে দিছি।
খুব ভালো করেছ।
তাইলে স্যার যাই। স্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
রিকশাওয়ালা চলে যেতেই আহসানের ইচ্ছে করল রেবা বা পারুল নামের ঐ মেয়েটিকে খুঁজে বের করতে। যে মেয়েটি দেখতে তারিনের মতো। তাকে কিছু টাকা-পয়সা দিতে ইচ্ছে করছে। আজকের রাতে সে যেন নিজের ঘরে গিয়ে আরাম করে ঘুমুতে পারে। আজ যেন কেউ তাকে বিরক্ত না করে। হয়ত এই মেয়েটির ঘরে পঙ্গু স্বামী আছে, শিশুপুত্র আছে। আজ রাতটি সে তার স্বামীর পাশে শুয়ে থাকুক। একটি হাত রাখুক স্বামীর গায়ে।
আহসান এগিয়ে গেল সিগারেটের দোকানের দিকে। এরা গভীর রাত পর্যন্ত ছোট দোকান সাজিয়ে বসে থাকে। নিশিকন্যাদের খবর এরাই সবচেয়ে ভালো জানবে।
একটা রোগামতো ফর্সা মেয়ে। বাজে টাইপের মেয়ে এদিকেই থাকে। তুমি দেখেছ তাকে? রেবা কিংবা পারুল নাম।
দোকানদার রাগী চোখে তাকিয়ে রইল। আহসান বলল, তুমি তাকে দেখ নি কোনো দিন।
দেখছি। দেখমু না কেন? আল্লায় চউখ দিছে দেখনের লাগিন।
আজ দেখেছ?
না। তয় বাস স্ট্যান্ডের কাছে গিয়ে দেখেন। রাইত বেশি হইলে ঐখানে দাঁড়াইয়া কাস্টমার খুঁজে।
রেবা বা পারুল নামের মেয়েটিকে পাওয়া গেল। পুরোপুরি নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার হাতে চটের একটা ব্যাগ। আহসানকে দেখে সে একটুও চমকাল না বা অবাক হল না। বিস্মিত হবার ক্ষমতা সম্ভবত এ-জাতীয় মেয়েদের নষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবীর কোনো কিছুই তাদেরকে আর অভিভূত করতে পারে না।
কেমন আছ পারুল।
মেয়েটি জবাব দিল না। চোখ বড়-বড় করে তাকাল।
অন্য স্যাডেলটি খুঁজে পেয়েছিলে?
না।
এস আমার সঙ্গে। আমি দেখেছি কোথায় আছে।
পারুল নিঃশব্দে এগিয়ে এল।
তোমার হাতে ব্যাগ কেন? ব্যাগে কি আছে?
সদাই।
ঐ দিন কিছু না বলে চলে গেলে আমি তোমাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম।
খামাখা টেকা দিবেন কেন?
খামাখা নয়। কারণ আছে।
আহসান আশা করছিল মেয়েটি বলবেকি কারণ? কিন্তু সে বলল না। নিঃশব্দে পেছনে-পেছনে আসতে লাগল।
ঐ যে দেখ তোমার স্যান্ডেল।
মেয়েটি গভীর মমতায় স্যান্ডেলটি তুলল। আহসান অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, তুমি কি এখানে ফুলের গন্ধ পাচ্ছ? এই জায়গাটার একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মাঝে-মাঝে ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় অথচ আশেপাশে কোনো ফুলের গাছ নেই।
ফুলের গন্ধ না। আগরবাতির গন্ধ।
আগরবাতির গন্ধ?
হুঁ পীর সাবের একটা মাজার আছে দোকানের পিছনে। এরা আগরবাত্তি জ্বালায়।
ও আচ্ছা। হ্যাঁ তাই। এখন মনে হচ্ছে আগরবাতিরই গন্ধ। এই জিনিসটি নিয়ে। আমি অনেকদিন ভেবেছি বুঝলে? কারণটা বের করতে পারি নি।
মেয়েটি হাসছে। সরল সহজ হাসি। পৃথিবীর কোনো মালিন্য সেই হাসিকে স্পর্শ করে নি।
পারুল।
জ্বি।
এস আমার সঙ্গে।
মেয়েটি ছোট-ছোট পা ফেলতে লাগল। আহসান বলল, তোমার যখন টাকা-পয়সার দরকার হবে আসবে আমার কাছে, কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার স্ত্রীর চেহারার সঙ্গে তোমার খুব মিল আছে এই জন্যেই একথা বলছি।
কতদিন আপনে আর আমারে টেকা দিবেন? আমার দুইটা মাইয়া আছে। না খাইয়া সারা দিন বইসা থাকে। দুনিয়াডা খুব খারাপ জায়গা ভাইজান।
হ্যাঁ খুবই খারাপ। দি উইন্টার অব ডিসকনটেন্ট।
পারুল দাঁড়িয়ে পড়ল। শান্তস্বরে বলল, আপনের কাছ থাইক্যা টেকা নিতাম না।
কেন?
ঝড় বৃষ্টি আইতাছে ঘরে যামু।
হেঁটে হেঁটে যাবে?
জ্বি।
চল তোমাকে খানিকটা এগিয়ে দিই।
না। আপনে ঘরে যান।
মেয়েটি ঘুরে দাঁড়াল। পরক্ষণেই দ্রুত পা ফেলতে লাগল।
বাতাস বইতে শুরু করেছে। শিগগিরই বৃষ্টি নামবে। মেয়েটি কি পারবে বৃষ্টির আগে আগে ফিরে যেতে হয়ত পারবে হয়ত পারবে না।
লাইনটির মানে
করিম সাহেবের বাড়ির সবগুলো আলো জ্বলছে, কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে দূর থেকে। আজ এদের খুব দুঃখের রাত।
আহসান নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। বারান্দায় জলিল মিয়া এবং তার হেপ্পার উবু হয়ে বসেছিল। তারা তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
ঝড় বৃষ্টি শুরু হল রাত বারটার দিকে। ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিকে নিকষ অন্ধকার। আহসান মোমবাতি জ্বালিয়েছে। বাতাসের ঝাপটায় মোমবাতি নিবু-নিবু হয়েও আবার জ্বলে উঠছে। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে কান্নার শব্দ মিলে গিয়ে কি যে অদ্ভুত শোনাচ্ছে।
এই রাতটির সঙ্গে তার বিয়ের রাতের বড় অদ্ভুত মিল তো। বিয়ের রাতেও ঠিক এই ব্যাপার। তাদের বাসর দোতলায়। হঠাৎ করে ঠিক করা। ফুলটুল কিছুই জোগাড় হয় নি। পুরনো আমলের বিশাল পালঙ্কে বড়-বড় ফুল আঁকা একটা চাদর শুধু বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানালার একটা কাঁচ ভাঙা। কাঁচের ভেতর দিয়ে বারবার পানির ঝাপটা আসছে। ইলেকট্রিসিটি নেই। দুটি মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। অনেক রাতে হাতে একটা হারিকেন নিয়ে তারিন ঢুকল। আহসান বলল, বাসর রাতে হারিকেন। ভারি কুৎসিত ব্যাপারটা বাইরে রেখে আস।
হুঁ, তারপর অন্ধকারে ভূতের ভয়ে কাঁপি। হারিকেন থাকবে। ইস পালঙ্ক তো ভিজে জবজবে। এসোনা ধরাধরি করে পালঙ্কটা সরাই।
দুজনে বহু ঠেলাঠেলি করেও সেই গন্ধমাদন পর্বত একচুল সরাতে পারল না। তারিন বলল, নিচ থকে দু একজনকে ডেকে আনব? আহসান বলল, থাক ডাকতে হবে না।