কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার বিয়ে সত্যি-সত্যি হচ্ছিল। তের-চৌদ্দ বছরের একটা মেয়ে সেজেগুজে বসে আছে। কাগজের চেইন দিয়ে ঘর সাজান। দুটি কলাগাছ পুঁতে গেট।
শুধু পাঞ্জাবির টাকা নয়, মেয়েটির জন্যে একটি শাড়ি। মাইক ভাড়া করবার জন্যে দুশ টাকা দিয়ে তারিন ঘোষণা করল বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে এখানে থাকবে। আহসান রাগী গলায় বলল, তার কোন দরকার আছে?
আছে। এই লোকটিকে আমি অন্যায়ভাবে সন্দেহ করেছি। আমার খুব খারাপ লাগছে। তাছাড়া বেচারা তার মেয়ের বিয়ের দিনও রিকশা চালাচ্ছে, আমার মনটা ভেঙে গেছে। আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। তুমি বুঝতে পারবে না। ছোটখাট জিনিস আমাকে খুব কষ্ট দেয়।
সত্যি-সত্যি তুমি থাকবে?
হ্যাঁ থাকব? তুমি এক কাজ কর না কেন? তুমি চলে যাও।
আহসান যেতে পারে নি। সে থেকে গেল এবং অবাক হয়ে লক্ষ করল মেয়ে বিদায়ের সময় যখন চারদিকে কান্নাকাটির মাতম উঠল তখন তারিন আড়ালে সরে গেল কারণ তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যেন কেউ দেখে না ফেলে।
অনেকদিন পর ঐ রিকশাওয়ালাটির সঙ্গে আহসানের দেখা হয়েছিল। আহসান চিনতে পারে নি। লোকটির চেহারা বদলে গেছে। দাড়ি রেখেছে। শরীর হয়েছে আরো দুর্বল। রিকশা এখন প্রায় টানতেই পারে না। সে ক্লান্ত গলায় বলল, স্যার, ভালো আছেন? আমারে চিনছেন?
না।
আমার মাইয়ার বিয়া দিলেন আপনারা।
ও আচ্ছা। তোমার মেয়ে ভালো আছে?
জ্বি না। মাইয়াটা মারা গেছে।
আহসান চুপ করে গেল। রিকশাওয়ালা বলল, আম্মা কেমন আছেন?
আমার স্ত্রীর কথা বলছ? সেও মারা গেছে। বাচ্চা হতে গিয়ে মারা গেছে। বেশিদিন হয় নি। মাস ছয় হল।
রিকশাওয়ালা রাস্তার পাশে রিকশা থামায়। তারপর সমস্ত পথচারীদের সচকিত করে হাট-মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। এই তীব্র আবেগের ভগ্নাংশ হয়ত তারিনের জন্যে বাকি সবটা তার কন্যার শোক।
তারিনের মৃত্যুর পর একবারও আহসান কাঁদে নি। চোখ ভিজে ওঠে নি কখনো। মানুষ বড় আশ্চর্য প্রাণী। তারিনের কথা আজ কাল মনেও পড়ে না। চোখ বন্ধ করে চেহারা মনে করতে চাইলেও লাভ হয় না। চেহারা মনে পড়ে না। ফর্সা, রোগা, লম্বা একটি মেয়ে যে বেশিরভাগ সময়ই চুল ছাড়া রাখে এবং সেই চুলে দু চোখের খানিকটা ঢাকা পড়ে থাকে তার সত্যিকার চেহারাটা কেমন? ছবির সঙ্গেও তার চেহারাটা ঠিক মিলানো যায় না। সবসময় মনে হয় তারিন অন্যরকম ছিল। ছবিতে চেহারা আসে নি।
হাসপাতালে যাবার আগে হঠাৎ একদিন বলল, কেন জানি মনে হচ্ছে হাসপাতাল থেকে আর ফিরে আসব না। ইট ইজ এ ওয়ান ওয়ে জার্নি।
আহসান হাসতে হাসতে বলেছে, প্রতিটি গেনেন্ট মেয়ে যখন হাসপাতালে যায় তখন তার এই কথা মনে হয়। সে ঠিকই ফিরে আসে।
ধর যদি না আসি তখন কী হবে?
কি হবে বলতে কী মিন করছ?
তোমার খুব নিঃসঙ্গ লাগবে না?
লাগারই তো কথা।
বিয়ে তো করবেই। করবে না।
এখন কী করে বলি? সময় আসুক।
বিপত্নীক মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করে। ওরা নিঃসঙ্গ বোধ করে সেই জন্যেই করে। এতে ওদের কোনো দোষ নেই।
আমি বিয়ে করলে তোমার আপত্তি হবে না।
তারিন সহজ স্বরে বলল, না আপত্তি হবে কেন? তবে একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন। তোমার ভালোর জন্যেই বলছি। কিছুদিন অপেক্ষা করবে।
কীসের জন্যে অপেক্ষা?
মনে কর চট করে তুমি বিয়ে করে ফেললে। নতুন একটি মেয়ে এল অথচ তখনো আমার কথা তোমার পুরোপুরি মনে আছে। তুমি সারাক্ষণ আমার সঙ্গে মেয়েটির তুলনা করবে। নিজে কষ্ট পাবে মেয়েটিকেও কষ্ট দেবে। কাজেই তোমার উচিত হবে। বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করা।
আহসান হাসতে হাসতে বলল, কতদিন?
তুমি চোখ বন্ধ করে আমার মুখ কল্পনা করার চেষ্টা করবে। যেদিন দেখবে আর কল্পনা করতে পারছ না সেদিন তোমার মুক্তি।
তারিনের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আহসান তার মুখ কল্পনা করতে চেষ্টা করল। পারল না। অসহ্য কষ্টে সারা রাত জেগে রইল। মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী। তারিন শুধু নিজেই চলে যায় নি সবকিছু সঙ্গে নিয়ে গেছে। এমন করল কেন সে?
তারিন মারা গিয়েছিল রক্তক্ষরণজনিত কারণে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান রক্তপাত বন্ধের জন্যে কিছুই করতে পারল না। তিন দিনে সাত বার রক্ত দেওয়া হল। অষ্টমবারের বার তারিন বলল, আর না। বাদ দিন। আমার ছেলেকে আমার পাশে শুইয়ে দিন। আর ছেলের বাবাকে একটু আসতে বলুন।
আহসান পাশে এসে বসল। তারিন মৃদু গলায় বলল, কি হচ্ছে বুঝতে পারছ?
কিছু হচ্ছে না। তুমি সুস্থ হয়ে বাসায় যাবে।
যেতে পারলে মন্দ হত না। তুমি এখন আর আমার সামনে থেকে নড়বে না। হাত ধরে বসে থাক। লজ্জা লাগছে না তো আবার?
না লজ্জা লাগছে না।
তারিন ফিসফিস করে বলল, Since there is no help come let us kiss and say good bye.
কি-সব আজেবাজে কথা বলছ?
ঠাট্টা করছি। মরতে বসেছি বলে কি ঠাট্টাও করতে পারব না? তোমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি।
তারিন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতো খিল-খিল করে হেসে উঠল। সতেজ প্রাণময় হাসি। সে মারা গেল তার মাত্র চার ঘন্টা পর। মৃত্যুর সময় তার জ্ঞান ছিল না। থাকলে হয়ত তখনো মজার কিছু বলার চেষ্টা করত। বেঁচে থাকাটা তার জন্যে খুব সুখের ব্যাপার ছিল বলেই বোধ হয় সে বেঁচে থাকতে পারল না।
রিকশা আদাবর পর্যন্ত ঠিক করা কিন্তু আহসান শ্যামলীতে নেমে পড়ল। সাত টাকা ভাড়া ঠিক করা ছিল সে দিল দশ টাকা। কোমল স্বরে বলল, ভাঙতি ফেরত দিতে হবে না। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। আহসান বলল, বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।