আহসান চমকে উঠে বলল, ওদের নাম জান তুমি?
হ্যাঁ জানি।
কী করে জান?
আপনার খোঁজে একবার গিয়েছিলাম। তখন আলাপ হয়েছে।
কই আমি তো কিছু জানি না। ওরা তো আমাকে কিছু বলে নি। অবশ্যি এমনিতেও ওদের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয় না। মেয়েগুলো খুব লাজুক।
লাজুক কিনা জানি না তবে মাথায় ছিট আছে। একদিন নিউ মার্কেটে ওদের সঙ্গে দেখা। তিন বোন একসঙ্গে ওজনের যন্ত্রে দাঁড়িয়ে ওজন নিচ্ছে। তিন জন একসঙ্গে ওজন নেবার পেছনে যুক্তিটা কি বলুন তো?
আহসান শব্দ করে হেসে উঠল। জেরিন বলল, আপনি কি জানেন এই মেয়ে তিনটি আপনাকে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে মহল মেয়েটি।
কি করে বুঝলে?
ওর বড় দু বোন আমার সামনেই এসব নিয়ে মহলকে ক্ষেপাতে লাগল। শেষে সেই মেয়ে কেঁদে-টেদে অস্থির। আচ্ছা দুলাভাই, আপার সঙ্গে কি মহল মেয়েটির কোনো মিল আছে?
না কোনোই মিল নেই।
তাহলে ঐ মেয়েটিকে এত পছন্দ করেন আর আমাকে এত অপছন্দ করেন কেন? আমার সঙ্গে তো আপার খুব মিল আছে। ভালো করে দেখুন আমি কি দেখতে অবিকল আপার মতো না?
না।
আপার মত হলে বোধ হয় এখানে থেকে যেতে রাজি হতেন।
বোধ হয়। উঠি জেরিন। তুমি কি আমাকে একটা ছাতা এনে দিতে পার?
মনে হয় পারি।
জেরিন ছাতা এনে দিল। অস্বাভাবিক কোমল স্বরে বলল, দুপুরের ঘটনার জন্যে আমি খুবই লজ্জিত। কিছু মনে করবেন না।
আমি কিছুই মনে করি নি।
যাবার আগে শুধু একটা কথা বলে যান-আপার কোন জিনিসটা আপনার কাছে খারাপ লাগত। আগেও প্রশ্ন করেছিলাম, জবাব দেন নি।
তোমার আপার সঙ্গে মাত্র তের মাস একসঙ্গে কাটিয়েছি। প্রচণ্ড একটা সুখের মধ্যে সময় কেটে গেছে। খারাপ কিছু চোখে পড়বে কীভাবে?
আপা খুব ভাগ্যবতী।
বিয়ের তের মাসের মাথায় মরে গেল এই জন্যে?
হ্যাঁ। আমিও ঠিক করে রেখেছি বিয়ের তিন মাসের মাথায় বিষ খেয়ে মরে যাব।
একবার তো শুনেছিলাম সারা জীবন বিয়ে করবে না। মত পাল্টেছ?
না। কথার কথা বলছি। ঠাট্টা করছি।
জেরিন গেট পর্যন্ত এল। ক্লান্ত গলায় বলল, অনেকক্ষণ বক-বক করেছি, কিছু মনে করবেন না। দুপুর বেলার ঘটনার জন্য আমি লজ্জিত।
কি মুশকিল, এককথা কবার বলবে?
ঠিক আছে আর বলব না।
জেরিন একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল, কেন ফেলল আহসান বুঝতে পারল না। খুব জটিল ব্যাপার আমরা অনেক সময় চট করে বুঝে ফেলি, আবার খুব সহজ জিনিস বুঝতে পারি না।
রিকশাওয়ালা রোগা।
কিন্তু রিকশা চালাচ্ছে ঝড়ের বেগে। বৃষ্টি নামবার আগেই বাড়ি ফেরার ইচ্ছে। কিংবা রিকশা জমা দেবার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। আহসান বলল, রিকশা কোন জায়গার?
মিরপুর।
থাক কোথায়? মিরপুর?
হুঁ। মিরপুর এক নম্বর।
ছেলে-মেয়ে আছে?
হুঁ।
কজন?
রিকশাওয়ালা জবাব দিল না। আহসান লক্ষ করেছে কোনো রিকশাওয়ালাই ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহ বোধ করে না বরং বিরক্ত হয়। এই রিকশাওয়ালাটি যেমন হচ্ছে।
রিকশায় উঠে লম্বা আলাপ জুড়ে দেবার স্বভাবও আহসানের নয়। এই বদ অভ্যাসটি রিনের। অচেনা, অজানা যে-কোনো মানুষের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেবে। একদিন আহসান বলেই বসল, কি বিশ্রী স্বভাব। অচেনা একজন মানুষের সঙ্গে কি আলাপ শুরু করলে? এটা খুবই বদ অভ্যাস। তারিন হাসতে হাসতে বলেছে, বদ অভ্যাসটা ছিল বলেই তোমার সঙ্গে পরিচয় হল। নয়ত তোমার সঙ্গে পরিচয় হত না। কি ঠিক বলছি না।
তাই বলে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে আলাপ জুড়বে?
আলাপ কোথায়? দুএকটা কথা জিজ্ঞেস করি।
জিজ্ঞেস করে তো ঝামেলার সৃষ্টি কর।
না-হয় হলই খানিকটা ঝামেলা।
খানিকটা না, মাঝে-মাঝে বেশ বড় রকমের ঝামেলা হয়। একজন বলে বসল। তার মেয়ের বিয়ে। সবকিছু যোগাড় হয়েছে শুধু জামাইয়ের জন্যে পাঞ্জাবি যোগাড় হয়। নি। এখন যদি পাঞ্জাবির দামটা দেন। সবটা দিতে হবে না। তিরিশ টাকা তার কাছে। আছে। তারিন বলল, আর কত টাকা হলে পাঞ্জাবি হয়?
পঞ্চাশ টেকা আম্মা। পঞ্চাশ হইলেই হয়।
আহসান এই সময়ে ইংরেজিতে বলল, একটা কথাও বিশ্বাস করবে না। ডাহা মিথ্যা কথা বলছে।
সত্যিও তো হতে পারে। বেনিফিট অব ডাউট বলে একটা কথা আছে।
ওটা হচ্ছে আদালতের কথা। এটা আদালত না।
আদালত না হলেও আমার মনে হয় লোকটা সত্যি বলেছে।
আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখতে পারি লেকটা মিথ্যা কথা বলেছে।
তারিন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেছে, এক কাজ করলে কেমন হয়? চল রিকশাওয়ালাকে বলি আমাদের তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যাক সত্যি-সত্যি তার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে কিনা।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে নাকি?
পাগলের কি আছে। একটা এ্যাডভেঞ্চার।
অসম্ভব। তারচেয়ে তুমি ওকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দাও। ঝামেলা চুকে যাক।
না না চল ওর বাসায় যাই।
ইংরেজি কথাবার্তা বন্ধ করে তারিন এবার পরিষ্কার বাংলায় বলল, এই রিকশা চল তোমার বাড়ি যাব। দেখব তোমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে কি-না।
রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে রিকশা থামাল। নিচু গলায় বলল, সত্যি যাইবেন।
হ্যাঁ, কোথায় তোমার বাসা?
সোবানবাগ।
চল সোবহানবাগে।
সত্যি যাইবেন?
হ্যাঁ, যাব।
আহসান বলল, ফর গডস শেক এখন আমরা একটা কাজে যাচ্ছি তারিন।
তেমন কোনো জরুরি কাজ না। ঘন্টা খানেক পরে গেলেও ক্ষতি হবে না। এই রিকশা চল।
রিকশাওয়ালা গামছা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছতে লাগল। আহসান বলল, এই দেখ সে যেতে চাচ্ছে না। তার মানে পুরো ব্যাপারটাই বানানো। ও বিয়েই করে নিওর মেয়ে আসবে কোত্থেকে।