আহসান কিছুই বলল না। জলিল মিয়া পানের পিক ফেলে বলল, এই সব ছোট কাজ করব আমার মতো মানুষ, আপনে হইলেন–। জলিল মিয়া কথা শেষ করল না। মাঝপথে থেমে গেল। আহসান বলল, মহল খুব কাঁদছিল?
জ্বি। বয়স কম মেয়ে। দুনিয়ার হালচাল তো জানে না। এরা ভাবে এক রকম দুনিয়া চলে অন্য রকম। প্ৰবেসার সাব রিকশা নিয়া তাড়াতাড়ি যান গিয়া। আকাশের অবস্থা খারাপ।
আহসান রিকশা নিল না। হাঁটতে শুরু করল। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জোর বৃষ্টি হবে। হোক। পৃথিবী ভাসিয়ে নিয়ে যাক। ভিজতে ইচ্ছে। করছে। কি যেন সেই গানটা—এসো কর স্নান নবধারা জলে, এসো নীপবনে।
জেরিন দরজা খুলল। খুশি-খুশি গলায় বলল, সত্যি তাহলে এলেন? আমার মনে হচ্ছিল—শেষ পর্যন্ত বোধ হয় আসবেন না।
বলে গিয়েছিলাম তো আসব।
তা বলে গিয়েছিলেন। পুরোপুরি বিশ্বাস করি নি। মনে হচ্ছিল পালাতে চাচ্ছেন বলে একটা অজুহাত তৈরি করেছেন।
পালাতে চাইলেও সবসময় পালানো যায় না।
ভালোই বলেছেন। যারা পালাতে চায় না তারাই শুধু পালাতে পারে। যেমন তারিন আপা। আপনার রুগী কেমন?
ভালো না। বাঁচবে বলে মনে হচ্ছে না।
আপনাকে তার জন্যে খুব একটা দুঃখিত মনে হচ্ছে না।
দুঃখিত মনে হওয়ার কারণও নেই। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মরছে।
খাবার দিতে বলি। হাত-মুখ ধোবেন তো?
হ্যাঁ ধোব।
জেরিন এবং আহসান খেতে বসল। অপরিচিত একটা কাজের মেয়ে শুধু খাবারদাবার এগিয়ে দিচ্ছে। এই বাড়িতে কোনো কাজের লোকই বেশি দিন টেকে না। জেরিন লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, বাবা শুয়ে পড়েছেন। বাবার তো সব ঘড়ি ধরা, সাড়েদ দশটা বাজতেই বাতি নিভিয়ে নিদ্রা। মার মাথা ধরেছে। কাজেই খাবার সাজিয়ে একমাত্র আমিই আপনার জন্য জেগে আছি।
থ্যাংকস।
আপনি যা-যা পছন্দ করেন সবই জোগাড় করার চেষ্টা করেছি। নিধুর মা তুমি চলে যাও। তোমাকে আর লাগবে না। খাওয়া শেষ হলে বলব, তখন টেবিল গোছাবে।
নিধুর মা চলে গেল। আহসানের খেতে ভালো লাগছে না। টেবিলে প্রচুর আয়োজন। প্রতিটি পদই চেখে দেখতে হবে ভেবেও বিরক্তি লাগছে।
খেতে কেমন হয়েছে?
ভালো।
আপনি যে তরকারিতে খুব ঝাল খান তা মনে ছিল না। সব তরকারিই বোধ হয় আপনার কাছে মিষ্টি-মিষ্টি লাগছে।
তুমি বেঁধেছ?
কেন আমি কি রাঁধতে জানি না?
রাতদিন পড়াশোনা নিয়ে থাক, তাই বলছি।
দুলাভাই, আপনি কিন্তু কিছু খাচ্ছেন না।
শরীরটা ভালো নেই জেরিন। কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না। তুমি খাও আমি বসে-বসে দেখি।
জেরিন একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। মৃদু স্বরে বলল, বাবাকে আপনি চমৎকার একটা মিথ্যা কথা বললেন। শ্বশুরকে খুশি করে দিলেন।
মিথ্যা নাও তো হতে পারে। কোনো দিন দ্বিতীয় একটি মেয়েকে বিয়ে করব না এমন প্রতিজ্ঞা ছিল না।
আমার মনে হয় আপনি বাবাকে মিথ্যা বলেছেন। আজকের রাতটা আপনার জন্য খুব একটা বিশেষ রাত। এই রাতে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ের প্রসঙ্গ আপনি তুলতেই পারেন না। তুলেছেন কারণ আপনি বাবাকে নিশ্চিত করতে চেয়েছেন।
ঠিকই ধরেছ।
দুলাভাই, আপনার সঙ্গে আমি রূঢ় আচরণ করেছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। আমি ভালো করেই জানি ঐ চিঠি আপনার বাবা নিজে থেকেই লিখেছেন। সেখানে আপনার কোনো ভূমিকা নেই।
জানতে যখন তখন এ কথাগুলো বললে কেন?
খুব রাগ হচ্ছিল বলে বলেছিলাম। রাগের সময় আমরা অনেক অন্যায় কথা বলি। বলি না?
তা অবশ্যি বলি।
দুলাভাই আপনি কি আমাকে খুব অপছন্দ করেন?
অপছন্দ করব কেন?
আমার মনে হয় করেন। আপার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই এই কারণেই করেন।
আহসান হেসে ফেলল। জেরিন গম্ভীর গলায় বলল, কেউ আমাকে অপছন্দ করলে আমার খুব খারাপ লাগে। আমার সব সময় ইচ্ছা করে আমাকে সবাই ভালবাসুক।
তোমার একার না। এরকম ইচ্ছে আমাদের সবারই করে।
আমার একটু বেশি করে। আশ্চর্য কাণ্ড কি জানেন, আমার তেইশ বছর বয়স হল এখন কেউ আমাকে ভালবাসার কথা বলে নি।
এখনো তো সময় সামনে আছে-ভবিষ্যতে বলবে।
যদি বলে তাহলে হয়ত তার মুখের ওপর হেসে ফেলব।
হ্যাঁ সেই সম্ভাবনাও আছে।
আহসান উঠে পড়ল। হাত ধুতে-ধুতে বলল, এখন বাসার দিকে রওনা হব। তুমি আমার জন্যে যে মমতা দেখিয়েছ তা আমি অনেক দিন মনে রাখব। সো নাইস অব ইউ।
জেরিন বিস্মিত হয়ে বলল, যাবেন মানে? কোথায় যাবেন?
বাসায় যাব। কাল ক্লাস আছে। পড়া তৈরি করব। মাস্টারদের ছাত্রদের মতো পড়া তৈরি করতে হয়।
আপনাদের পুরনো বাসরঘর এত কষ্ট করে সাজিয়ে রাখলাম আর আপনি চলে যাবেন?
ঐসব ছেলেমানুষির বয়স কি এখন আছে? গল্প-উপন্যাসে এ-সব মানায়। শূন্য বাসরঘরে নায়ক ঢুকবে পুরানো স্মৃতি মনে পড়বে। সবই আছে শুধু সে নেই। বালিশের পাশে বাসি ফুলের মালা। বিছানায় স্মৃতিময় চুলের কাঁটা।
দুলাভাই আপনি কিন্তু যেতে পারবেন না। আপনি চলে গেলে আমার খারাপ লাগবে। খুবই খারাপ লাগবে।
খারাপ লাগবে কেন?
দুপুরে আপনার সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেছি। এই জন্যেই খারাপ লাগবে।
এ-সব নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না জেরিন।
আমি জানি আপনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। কারণ আমাকে আপনি খুবই তুচ্ছ জ্ঞান। করেন। আমি একটা মন্দ কথা বললেও আপনার কিছু যায়-আসে না।
এক জিনিস নিয়ে তর্ক করতে ভালো লাগছে না। ঠিক আছে তুমি খুবই তুচ্ছ। দয়া করে এক কাপ চা দাও। খেয়ে চলে যাব। ঝড়-বৃষ্টি হবে।
জেরিন গম্ভীর মুখে চা বানিয়ে আনল। এবং খুবই হালকা গলায় বলল, আপনি আপনার বাড়িওয়ালার যে মেয়েটিকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছিলেন তার নাম কি মহল?