আহসান বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। বিছানায় যে পড়ে আছে সে একজন মৃত ব্যক্তি। কোন একটি অসম্ভব অলৌকিক উপায়ে সে কথা বলছে। এরকম একটি মানুষের কথা বলতে পারার কোনো কারণ নেই।
মহল, প্রফেসর সাহেবকে বসতে দে।
আপনি কথা বলবেন না। চুপ করে থাকুন।
আপনি দেখতে এসেছেন বড় ভালো লাগছে প্রফেসর সাব। আমি এদের বলতেছিলাম প্রফেসর সাব আসবে। না এসে পারে না। মানুষ তো আমি চিনি। ব্যবসা করি, মানুষ চরাইয়া খাই। মানুষ না চিনলে চলে?
প্লিজ কথা বলবেন না।
প্রথম বাড়ি ভাড়া নিতে যখন আসলেন আমি বেগমের মার বললামখাটি লোক একটা। বেগমের মা বলল, বড় বড় মেয়ে ঘরে আমি বললাম, এ ফেরেশতা লোক, তোমার মেয়েগুলোর দিকে কোনদিন চোখ পড়বে না। কি কথা ঠিক হইল।
করিম সাহেব বিজয়ীর মত তাকালেন স্ত্রীর দিকে। বেঁটেখাটো মলিন মুখের মহিলাকে ঘিরে তাঁর মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। ভদ্রমহিলা বসে আছেন। সবচেয়ে ছোটো মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে। মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে বেগমের দূর সম্পর্কের ফুপু খুব নিচু গলায় কোরান শরীফ পড়ছেন।
প্রফেসর সাব।
জ্বি বলুন।
বোধ হয় বাঁচব না। আমার মাকে গত রাতে বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখলাম। পরিষ্কার দেখলাম কোন ভুল নাই। মরবার আগে আত্মীয়স্বজনের রুহ। দেখা যায়।
আপনি ভালো হয়ে উঠবেন শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন। ভয় আমি পাচ্ছি না প্রফেসর সাব। মরণের খামাকা ভয় পাব কেন বলেন? মরণ তো আছেই। ভয় পাইতেছি অন্য জিনিসে। সেইটা আপনারে বলতে চাই।
আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর বলবেন।
জ্বি না, এখনই বলতে হবে। আমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। বড় বড় লোকসান দিয়ে শেষ হয়ে গেছি। বাজারে বিরাট দেনা। দশ-বার লাখ টাকা দেন। মরে গেলে মেয়েগুলোর আমার সর্বনাশ হয়ে যাবে। একটু দেখবেন। খোঁজ রাখবেন। দেখাশোনা করবে সেই রকম আত্মীয় স্বজন আমার কেউ নাই।
করিম সাহেব, ঐসব নিয়ে চিন্তার সময় এখনো হয় নি।
হয়েছে, সময় হয়ে গেছে। কাউরে না বললে শান্তি হবে না। আমার মেয়েগুলো বোকা তার ওপর মূখ। মাথার ওপর কেউ না থাকলে ভেসে যাবে।
আপনি শান্ত হয়ে বিশ্রাম নিন। আমার যতদূর দেখার আমি দেখব।
করিম সাহেব চুপ করে গেলেন। চোখ বন্ধ করে বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলেন। মনে হল তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আহসান উঠে দাঁড়াল। লোকটির ঘুম না ভাঙিয়ে চলে যেতে হবে।
প্রফেসর সাব।
জ্বি!
চলে যাচ্ছেন?
ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছেন।
না ঘুমাই নাই। ঘুম হয় না। তার মতো হয়।
করিম সাহেব আবার কাশতে লাগলেন। দম নেবার মতো শক্তি সঞ্চয়ের পর তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা সব একটু বাইরে যাও আমি একটা কথা প্রফেসর সাবকে বলব। দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও না।
খুব অনিচ্ছার সঙ্গে সবাই বেরুল। করিম সাহেব বললেন, প্রফেসর সাব একটু কাছে আসেন একটা কথা বলব। আহসান এগিয়ে গেল।
আমার তিন নম্বর মেয়েটা যে আছে মহল—শুনছি তারে আপনি খুব স্নেহ করেন। দেখা হলে কথাটথা বলেন। মেয়েগুলো বোকা। পেটে কথা রাখতে পারে না। যা হয় সব তাদের মাকে বলে। তার মা বলে আমারে।
আহসান অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। করিম সাহেবের চোখ বন্ধ তবে তিনি কথা বলছেন বেশ পরিষ্কার গলায়।
বুঝলেন প্রফেসর সাব, তাঁর মার কাছ থেকে শুনলাম। একদিন নাকি মহলের কাছে আচার চেয়ে খেয়েছেন। মেয়েটা সব তার মাকে বলেছে। মেয়েটাকে যদি আপনার পছন্দ হয় — আমার মেয়েগুলো বোকা কিন্তু ভালো। মন্দ কিছু আর এদের মধ্যে নাই। আপনারে দিল থেকে কথাগুলো বললাম। দোষ হইলে মাফ কইরা দিবেন। আচ্ছা তাহলে এখন যান।
কথা শেষ হবার আগেই নার্স এবং হাসপাতালের এ্যাটেনডেন্ট ঢুকল। করিম সাহেবকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাবে। অল্প বয়স্ক একজন ডাক্তার নার্ভাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আহসান তাঁকে একপাশে নিয়ে নিচু গলায় বলল, অবস্থা কি খুব বেশি খারাপ?
তাই তো মনে হচ্ছে। মাথার আঘাতটা তেমন গুরুতর না, তবে লাংসে জখম আছে। অপারেশনের আগে বলা যাবে না।
সারভাইভালের সম্ভাবনা কেমন? বাঁচামরার ব্যাপারে তো স্ট্যাটিসটিকস চলে না।
আহসান নিদারুণ অস্বস্তি নিয়ে বের হল। অপারেশনের সময় এখানে থাকা উচিত। কিন্তু থাকতে ইচ্ছে করছে না। মেয়েগুলি এমন করে কাঁদছে যে সহ্য করা মুশকিল।
হাসপাতালের গেটে দেখা হল ড্রাইভার জলিল মিয়ার সঙ্গে। তার বগুড়া না কোথায় যেন যাবার কথা ছিল ট্রাক নিয়ে। বোধ হয় যায় নি। বিরস মুখে পান চিবুচ্ছে। আহসানকে দেখে এগিয়ে এল।
প্ৰবেসার সাব, সালাস্লামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
দেখে আসছেন?
হ্যাঁ।
ভালো করছেন। আপনার কথা খুব বলতেছিল। মরবার সময় মাথায় কিছু ঢুকলে ঐটা নিয়ে শুধু প্যাচাল পাড়ে। আপনার সাথে কথা বলনের শখ ছিল। শখ মিটল। আপনি কি এখন বাড়ি যান?
হুঁ।
আসেন রিকশা করে দিই।
রিকশা করে দিতে হবে না।
চলেন যাই। আপনার সাথে একটা ছোট কথাও আছে প্ৰবেসার সাব।
কি কথা?
মনে রাগ কিন্তুক নিবেন না।
না রাগ নেব না।
কাইল রাইতে কি আপনার ঘরে একটা মেয়েছেলে ছিল? সকালে দেখি গেইট দিয়া বাইর হয়। আমি আটকাইলাম। চোর না কি কে জানে? শেষে বুঝলাম অন্য ব্যাপার।
আহসান সিগারেট ধরাল। জলিল মিয়া বেশ শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার তার বক্তব্য শুরু করল, করিম সাবের মেয়ে তিনটা খুব মন খারাপ করছে। মেয়ে তিনটার মন খুব নরম। আপনারে খুব মানে। হেই কারণে মনে খুব কষ্ট পাইছে। মহল মেয়েটা তো কানতেছিল।