বড়ো লোকটি গভীর আগ্রহে তাকে লক্ষ করছে। তার কলার কাঁদি থেকে একটি কলা ছিঁড়ে পড়ে গেছে। সেই কলাটি সে অন্য হাতে ধরে আছে। সে ভেবে পাচ্ছে না ডাক্তারের মতো এই লোকটি একবার সিঁড়ির এই মাথায় যাচ্ছে একবার অন্য মাথায় যাচ্ছে কেন? সে ভয়ে-ভয়ে ডাকল, ডাক্তার সাব।
আমি ডাক্তার না। আপনাকে তো আগে একবার বলেছি। আর শুনুন, আপনি আমার পিছনে পিছনে হাঁটছেন কেন?
বুড়ো লোকটির কলার কাঁদি থেকে আরো একটি কলা ছিঁড়ে পড়ে গেল। সে কলাটি কুড়িয়ে ভয় পাওয়া ভঙ্গিতে দূরে সরে গেল। বড় মায়া লাগল আহসানের। মায়া ব্যাপারটি বেশ অদ্ভুত। হঠাৎ তেমন কোনো কারণ ছাড়াই কঠিন হৃদয় মানুষের মধ্যে এটা জেগে ওঠে তাকে অভিভূত করে দেয়। রিনের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ও ঐ মায়া নামক ব্যাপারটি কাজ করেছে।
সেই বিকেলে তার কিছু করার ছিল না। কিছু করার না থাকলে শুধু হাঁটতে ইচ্ছে করে। সে প্রায় সারা বিকেল হেঁটে ক্লান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের দিকে এল। ভ্যাপসা গরম। গায়ে ঘাম চটচট করছে। অসম্ভব তৃষ্ণা পেয়েছে। বার-বার মনে হচ্ছে শহরের জায়গায়-জায়গায় হাইড্রেন্ট থাকলে বেশ হত। তৃষ্ণার্ত ক্লান্ত পথচারী হাইড্রেন্ট খুলে চোখে-মুখে পানি দিত, আঁজলা ভর্তি পানি পান করত।
বাংলা একাডেমীতে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। রবীন্দ্র বা নজরুল এই দুজনের কোনো জয়ন্তী-টয়ন্তী হবে। হয়ত এই গরমে অনুষ্ঠান ঠিক জমছে না। যত লোক যাচ্ছে তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে আসছে। আইসক্রিমওয়ালারা ঘন্টা বাজিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কামড়ে-কামড়ে আইসক্রিম খাবার মতো বাজে জিনিস আর কিছুই নেই। তবু আহসান একটি আইসক্রিম কিনল আর ঠিক তখন ছ-সাত বছরের টোকাই শ্রেণীর একটি বালিকা তার ভাইকে কোলে নিয়ে আহসানের পাশে এসে দাঁড়াল। কড়া একটা ধমক দিতে গিয়েও ধমক দেওয়া গেল না। বালিকার চোখ দুটি অসম্ভব কোমল। আহসান আইসক্রিমওয়ালাকে বলল, এদের দুজনকে দুটি আইসক্রিম দাও।
কত দামের?
আমারটা যেমন সেরকম। আমারটার দাম কত?
আট টাকা।
আট টাকা। বল কি? আইসক্রিমের এত দাম নাকি?
চকবারের দাম বেশি।
দাও ওদের তাই দাও।
আইসক্রিমওয়ালা গম্ভীর মুখে দুটি আইসক্রিম বের করল। তখন গুটি-গুটি আর একটি বালক এসে উপস্থিত। কোমল চোখের মেয়েটি বলল, এ আমার ভাই।
দাও এর ভাইকেও একটা দাও।
আইসক্রিমওয়ালা বিরক্ত গলায় বলল, অত দিয়ে পার পাইতেন না—দুনিয়ার ফকির আইয়া বেড় দিব।
বাচ্চা তিনটি গভীর আগ্রহে আইসক্রিম খাচ্ছে। ঘোট ঘোট টুকরো ভেঙে মুখে দিচ্ছে। আহসান বলল, কি রে তোদর নাম কি? বড় মেয়েটি হেসে ফেলল। যেন অদ্ভুত কথা এই জন্মে শোনে নি। তাকে হাসতে দেখে অন্য দুজনও হাসতে লাগল।
হাসছিস কেন রে শুধু-শুধু?
এতে তাদের হাসি আরো বেড়ে গেল। আহসান লক্ষ করল শুধু এরাই হাসছে না। হাসিমুখে আর একজন তাকিয়ে আছে তার দিকে। লম্বা, রোগা একটি মেয়ে। বালিকাদের মতো নিগ্ধ মুখ। অনেকদিনের চেনা মেয়ের মতো সে বলল, এদের সঙ্গে আপনার দেখি খুব ভাব হয়ে গেছে।
আহসান কি বলবে ভেবে পেল না। মেয়েটি হাসিমুখে বলল, আপনি কি প্রায়ই এরকম করেন?
না।
আমার নাম তারিন, আমার বান্ধবীর আজ এখানে গান গাওয়ার কথা। সে আসে নি। কি কাণ্ড দেখুন না। অথচ আমি তার জন্যেই এসেছি।
কত সহজ কত স্পষ্ট ভঙ্গিতে কথা বলছে মেয়েটি। কোনো রকম জড়তা নেই, দ্বিধা নেই।
আহসান খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনি কি আমাদের সঙ্গে একটা আইসক্রিম খাবেন? মেয়েটি হাসতে-হাসতে বলল, জ্বি না। আমার টনসিলের সমস্যা আছে ঠাণ্ডা লাগলেই কথা বন্ধ হয়ে যায়।
পরবর্তী সময়ে আহসান যখন জিজ্ঞেস করেছে—একজন সম্পূর্ণ অচেনা একটি ছেলের সঙ্গে এতগুলো কথা তুমি ঐদিন কিভাবে বললে? তারিন ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলেছে—জানি না। কিভাবে বললাম। আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল তাই বলেছি। তুমি এত আন্তরিকভাবে ঐ বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলছিলে দেখে আমার খুব মায়া লাগল। তোমার ওপর মায়া পড়ে গেল।
এখন এই বড়ো লোকটির ওপর মায়া পড়ে গেছে। কলা হাতে নিয়ে কেমন। জবুথবু দাঁড়িয়ে আছে। কেউ তাকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। সে বোঘ হয় পুরো ঠিকানা নিয়ে আসে নি। আহসান এগিয়ে গেল।
আসুন, আপনার রুগী কোথায় বের করে দিচ্ছি। রুগীর নাম কি?
মোহাম্মদ ওসমান আলি।
কী হয় আপনার?
আমার আপন ভাইস্তা। আদমজী মিলে কাম করে।
কি কলা কিনেছেন সব তো ছিঁড়ে-ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে। দিন আমার কাছে কয়েকটা দিন।
বুড়ো, এই মানুষটির ভদ্রতায় অভিভূত হয়ে গেল।
করিম সাহেবের কেবিনের নম্বর
করিম সাহেবের কেবিনের নম্বর হচ্ছে এগার।
সাধারণত মরণাপন্ন রুগীর কেবিনের সামনে একটা জটলা লেগে থাকে। এখানে তা নেই। কেবিনের সামনের জায়গাটি একেবারে ফাঁকা। ভিড় দেখা যাচ্ছে ১৬ নম্বর কেবিনের সামনে। অত্যন্ত চমৎকার সব পোশাক পরা একদল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ কাঁদছে। যারা কাঁদছে তাদের মধ্যে একজন বিদেশিনীও আছে। স্কার্ট পরা বিদেশিনী, বাঙালি মেয়েদের মতোই শব্দ করে কাঁদছে।
আহসান এগার নম্বরের কেবিনের দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে যে—মেয়েটি মাথা বের করল সে মহল।
আসেন। ভেতরে আসেন। আবা, প্রফেসর সাহেব এসেছেন।
বিছানায় সাদা চাদরে ঢাকা মানুষটি নড়ে উঠল।
কেমন আছেন করিম সাহেব?
ভালো আছি। ভালো আছি। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ।