কি বল আহসান, উচিত না?
একটু বড় হোক। তারপর মাঝেমধ্যে নিয়ে রাখব। এখন নিলে কাঁদবে।
কাঁদবে কেন? বাবার কাছে কি ছেলে কাঁদে? মোটেই কাঁদে না।
মোটই কাঁদে না কথাটা ঠিক না। আহসানের শাশুড়ি মারুফকে কোলে নিয়ে বারান্দায় আসতেই মারুফ তার বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। সে এখানে আসবে না।
তোমাকে না দেখে দেখে এরকম হয়েছে।
আহসান কিছু বলল না। তার শাশুড়ি ছেলেকে তার কোলে দিতে চেষ্টা করতে লাগলেন। ছেলে কিছুতেই আসবে না। হাত-পা ছুঁড়ছে।
আহসান খানিকটা অপ্ৰস্তুত বোধ করছে। সে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি রে ভালো?
মারুফ পাথরের মতো মুখ করে রইল। আহসানের শাশুড়ি বললেন, খোকন তোমার পেঙ্গুইনের খেলনাটা বাপিকে দেখাবে না?
না।
দেখতে চাচ্ছে যে। আহসান তুমি পেঙ্গুইনের খেলনা দেখতে চাও। তাই না?
হ্যাঁ চাই।
খেলনাটা দেখার জন্য তোমার খুব লোভ হচ্ছে তাই না?
হ্যাঁ হচ্ছে।
এই জাতীয় কথাবার্তা দীর্ঘ সময় চালিয়ে যাওয়া খুবই বিরক্তির ব্যাপার। শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে আহসান চালিয়ে যায়। মারুফের মুখের কাঠিন্য তাতে বিন্দুমাত্র কমে না। এতে আহসানের শাশুড়ি বেশ আনন্দ পান। আহসানের ধারণা ছেলে যদি কোন দিন তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে মনের কষ্টে তার শাশুড়ির হার্ট অ্যাটাক হবে।
আহসান বলল, এখন উঠব, আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে হবে, একজনকে দেখতে যাওয়ার কথা।
তার শাশুড়ি অবাক হয়ে বললেন, তা কী করে হয়? আজ রাতে তো তুমি এখানে থাকবে। জেরিন তোমার জন্যে সকাল বেলা বাজার করিয়েছে। রান্নাবান্না হচ্ছে।
আমাকে যেতেই হবে। আমার চেনা একজন মানুষ এ্যাকসিডেন্ট করেছে। হয়ত মারা যাবে।
আহসানের কথাগুলো খুব বিশ্বাসযোগ্য হল না। মনে হল সে বানিয়ে-বানিয়ে একটা অজুহাত তৈরি করছে। তাও খুব জোরাল অজুহাত নয়।
তার শ্বশুর গম্ভীর গলায় বললেন, ঠিক আছে তুমি হাসপাতালে যাও ভদ্রলোককে দেখে চলে আস। সেখানে নিশ্চয়ই তোমাকে সারারাত থাকতে হবে না।
না তা হবে না।
ভদ্রলোক কে?
আমার বাড়িওয়াল করিম সাহেব।
অসুখটা কি?
টেম্পোর সঙ্গে এ্যাকসিডেন্ট করেছেন।
ও আচ্ছা, যাও। চা খেয়ে যাও। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
ভদ্রলোক একটা চুরুট ধরিয়ে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, তোমার বাবার শরীর কেমন? চিঠিপত্র পাও?
পাই। শরীর ভালোই সম্ভবত।
আমি অবশ্যি রিসেন্টলি একটি চিঠি পেয়েছি তাতে বাতে কষ্ট পাচ্ছেন বলে লিখেছেন। স্কুলেও কি সব ঝামেলা হচ্ছে।
আহসান অপেক্ষা করতে লাগল কখন জেরিনের প্রসঙ্গটি আসে। মনে হচ্ছে আসবে। না এলে চিঠির প্রসঙ্গ উনি আনতেন না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার প্রসঙ্গ উঠল না। উনি বৰ্ষার কথা নিয়ে এলেন। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে উনি জেরিনের প্রসঙ্গটি এনে ব্যাপারটা এখানেই মিটিয়ে দিতে চান। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় আনতে পারছেন না। আহসান বলল, আপনার সঙ্গে আমি একটি ব্যাপারে আলাপ করতে চাচ্ছিলাম।
কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু কি?
না তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।
তোমার শাশুড়িকেও ডাকি। ও বোধ হয় মারুফকে দুধ খাওয়াতে গেছে।
না ওনাকে ডাকার প্রয়োজন নেই। করিম সাহেবের কথা বলছিলাম না আপনাকে আমার বাড়িওয়ালা।
হ্যাঁ বলছিলে।
ভদ্রলোকের খুব ইচ্ছা তাঁর মেয়েকে আমি বিয়ে করি। আমিও ভাবছিলাম–
গুড ভেরি গুড। মেয়ে তোমার পছন্দ হলে অফকোর্স করবে। তোমার সারা জীবন তো সামনেই পড়ে আছে। ইয়াংম্যান —
আহসানের মনে হল তাঁর শ্বশুরের বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেছে। তিনি খুব হালকা বোধ করছেন। চট করে চমৎকার একটি মিথ্যা মাথায় আসায় ভালোই হয়েছে। ঐ চিঠির প্রসঙ্গ তিনি আর তুলবেন না।
আমি এখন উঠি?
ঘন্টা খানিকের মধ্যে চলে আসবে কিন্তু। খাবে এখানে।
ঠিক আছে।
এক কাজ কর না কেন? গাড়ি নিয়ে যাও। ড্রাইভার আছে।
না গাড়ি লাগবে না। মেডিক্যাল কলেজে যাব। কতক্ষণ থাকব কিছু ঠিক নেই।
আহসান উঠে দাঁড়াল।
বেশি দেরি করবেনা। এদিকে রেগুলার ছিনতাই-টিনতাই হচ্ছে। দেশে বাস করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
না দেরি করব না।
আহসানের শ্বশুর তাঁর সঙ্গে গেট পর্যন্ত এলেন। একবারও জিজ্ঞেস করলেন না করিম সাহেবের মেয়েটি কি পড়ে দেখতে কেমন? এই অসম্ভব ভদ্র, সংস্কৃতিবান পরিবারটির কেউই তার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায় না। একজন। একজন তারিন। আহসান ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল।
ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে গেছে বলেই বোধ হয় ভিজিটারদের সংখ্যা অনেক বেশি। গিজগিজ করছে চারদিকে। ফিনাইলের কড়া গন্ধ, ওষুধের গন্ধ এবং রোগ গন্ধ। কিছুক্ষণ থাকলেই মাথা ভার-ভার হয়ে যায়। বমি-বমি লাগে তবু যদি কেউ বেশিক্ষণ থাকে তাহলে যেতে চায় না। এইসব গন্ধের কোনো একটিতে সম্ভবত এ্যাডিকসনের কিছু আছে। যা মানুষকে আটকে ফেলে। ভাবতে-ভাবতে আহসান এলোমলোভাবে খানিকক্ষণ করিডোর দিয়ে হাঁটল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে করিডোর পরিচ্ছন্ন। এত মানুষজন যাওয়া আসার মধ্যেও করিডোর পরিচ্ছন্ন আছে কী ভাবে তাও একটা রহস্য। বুডোমতো একজন হাতে এক ডজন কলা নিয়ে অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে এ-মাথা ও-মাথা করছে। সে আহসানের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
ডাক্তার সাব, চই নম্বর কোনখানে?
হাসপাতালের কাউকে জিজ্ঞেস করুন। আমিও একজনকে খুঁজছি।
বুড়ো আসতে লাগল তার সঙ্গে-সঙ্গে। ডাক্তারদের চেহারা কি অন্যদের থেকে আলাদা? তারিন হাসপাতালে থাকার সময়ও কয়েকবার অপরিচিত লোজন তাকে ডাক্তার ভেবেছে। হাসপাতালের ডাক্তাররা অসম্ভব গম্ভীর থাকেন। অস্বাভাবিক একটি কাঠিন্য তাঁদের চোখে-মুখে মাখানো থাকে, তারও কি তাই?