আহসান হাসিমুখে বলল, বেশ নাটকীয় ওপেনিং ব্যাপার কী বলত?
আপনার বাবা, আমার বাবাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই চিঠি পড়ে বাসার সবাই খুব মন খারাপ করেছে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ করেছি আমি। আপনি বোধ। হয় জানেন না আমি কোনোদিন কাঁদি না, কিন্তু সেই চিঠি পড়ে খুব কেঁদেছি। কেঁদেছি কারণ আমার ধারণা ঐ চিঠি আপনি আপনার বাবাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। আপনার বাবা, সরি আমার বোধ হয় ভালই সাহেব বলা উচিত—নিজ থেকে এরকম একটা চিঠি লিখতে পারেন না।
চিঠিটা দেখি।
জেরিন ড়ুয়ার থেকে চিঠি বের করল, আহসানের হাতে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে। গেল। আহসানের অনেক সময় লাগল চিঠি শেষ করতে। তার বাবা কুতুবপুর এম. ই. হাই স্কুলের এ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার জনাব নেছারউদ্দিন অত্যন্ত প্যাঁচল অক্ষরে একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন—
॥ ইয়া রব ।।
প্রিয় বেয়াই সাহেব,
আসোলামু আলায়কুম। পর সমাচার এই যে, দীর্ঘদিন আপনার সঙ্গে পত্ৰ মারফত কোনো যোগাযোগ নাই। গত রমজানে আপনাকে একটি পত্ৰ দিয়াছিলাম সম্ভবত আপনার হস্তগত হয় নাই।
যাই হোক, একটি বিশেষ আবদার নিয়া আপনার নিকট এই পত্র প্রেরণ করিতেছি। আবদারটি আপনার তৃতীয় কন্যা জেরিন প্রসঙ্গে। এই অত্যন্ত সুলক্ষণা, বিদ্যাবতী ও গুণবতী কন্যাটির সঙ্গে আহসানের বিবাহ কি হইতে পারে না? যদি হয় তাহা হইলে মারুফ সম্পর্কে আমাদের সকলের সকল আশংকা দূর হয়। সৎ মার গৃহে শিশুদের কী অবস্থা হয় তা তো আপনার অজানা নাই। আমি নিজেও ভুক্তভোগী। মা জেরিনের সঙ্গে আহসানের বিবাহ দিতে পারিলে সব দিক নিশ্চিত হওয়া যায়। পত্র মারফত এইসব বিষয় আলোচনা করা সম্ভব না। বাধ্য হইয়া করিলাম। কারণ আমি বর্তমানে বাতব্যাধিতে শয্যাশায়ী। হাঁটাচলার সামর্থ্য নাই।
আপনি এই পত্রটি বেয়ান সাহেবকে দেখাইবেন। এবং তাঁহার সহিতও পরামর্শ করিবেন।
এই হচ্ছে চিঠি শুরুর প্রস্তাবনা। এরপরও নানান প্রসঙ্গ আছে। তাঁর অসুখের পূর্ণ বিবরণ আছে। কুতুবপুর এম. ই. স্কুল নিয়ে বর্তমানে যে পলিটিক্স চলছে এবং এই পলিটিক্সের ফলে যে স্কুলের অস্তিত্বই বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তার বিশদ বিবরণ আছে। এই অবস্থায় কি করা উচিত বলে বেয়াই সাহেব মনে করেন?—এইসবও আছে।
আহসান চিঠিটি খামে ভরে টেবিলের ওপর রাখল। জেরিন চা নিয়ে ঢুকছে। শান্ত ভঙ্গিতে টি-পট থেকে চা ঢালছে।
দুলাভাই, মা ফিরেছে। আমাকে বলেছে আপনাকে যেন চলে যেতে না দিই। মা নামাজ পড়েই আসবে। চায়ে চিনি হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
এখন আপনাকে আরেক কাপ চা খেতে হবে বাবার সঙ্গে। তিনি চা-নাশতা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
তাহলে আর এখানে চা দিলে কেন?
আপনি সিগারেট ছাড়া চা খেতে পারেন না এই জন্যে।
জেরিন হাসল। হাসতে-হাসতে বলল, আজ রাতে তো আপনি থাকবেন এখানে তাই না?
তেমন কোনো কথা ছিল কি?
না ছিল না। কিন্তু আমি জানতাম আজ আপনি আসবেন এবং রাতে থেকে যাবেন। আমি মাকে সকালবেলাতেই বলে রেখেছি ভালোমতো বাজার করতে।
আজ কি কোন বিশেষ দিন?
জেরিন তীব্র গলায় বলল, কেন প্রিটেন্ড করছেন? আপনি ভালোই জানেন আজ কোন দিন। জানেন বলেই এসেছেন। গত দু মাসে কি একবারও এসেছেন এ-বাড়িতে?
আহসানের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। আজ এগারই শ্রাবণ। এই দিনে পাঁচ বছর আগে তারিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। বাসর হয়েছিল এ-বাড়িতেই। খুব ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিল বলে বর-কনেকে যেতে দেওয়া হয় নি।
জেরিন ঠাণ্ডা গলায় বলল, যান বাবা বসে আছে। দেখা করে আসুন।
আহসানের শ্বশুর ইমতিয়াজ সাহেব ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। কোন কিছুতেই উত্তেজিত না হওয়ার অসাধারণ গুণটি তিনি আয়ত্ত করেছেন। সারাজীবন জজিয়তি করে-করে কথা না বলে শুধু শুনে যাওয়ার বিষয়টিও তাঁর মজ্জাগত হয়েছে। অসম্ভব ভদ্রলোক। নিজের জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলার সময়ও খুব লক্ষ রাখেন যেন কোথাও সৌজন্য এবং শিষ্টতা ক্ষুণ্ণ না হয়।
আহসানকে তিনি কখনো সহজভাবে নিতে পারেন নি। অবশ্যি তা বুঝতেও দেন নি; তবে এইসব ব্যাপারগুলি বোঝা যায়। আহসানের বুঝতে অসুবিধা হয় নি। নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে একবার সে তারিনকে বলেও ফেলল, তোমার বাবা আমাকে সহ্য করতে পারে না কেন বল তো?
তারিন খুবই স্বাভাবিকভাবে বলল, সবাই কি আর সবাইকে সহ্য করতে পারে? এমন যে মহাত্মা গান্ধী তাঁকেও তো অনেকে সহ্য করতে পারত না।
মহাত্মা গান্ধী অনেক বড় ব্যাপার। এইসব তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁর কিছু যায় আসে না। আমি ক্ষুদ্র ব্যক্তি আমার খারাপ লাগে।
আমারো লাগে কিন্তু কী আর করা।
না, করার কিছুই নেই। মেনে নেওয়া ছাড়া আর কি পথ আছে? আহসান মেনে নিয়েছিল। এ-বাড়িতে পা দিলে সে নিয়ম মাফিক কিছু সময় কাটাত ইমতিয়াজ সাহেবের সঙ্গে। ইমতিয়াজ সাহেব ন্যাশনাল জিওগ্রাফির পাতা বন্ধ করে অতি ভদ্ৰ স্বরে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলে এক সময় ইতি টানতেন। সেই ইতি টানার ব্যাপারটিও রুচি সম্মত।
যাও তোমাকে আর আটকে রাখতে চাচ্ছি না। বড়ো মানুষদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানো ভালো নয়—এতে মনের মধ্যে বুড়ো-বুড়ো ভাব ঢুকে যায়। যা মোটেই ডিজায়ারেবল নয়।
আহসান পাশের কামরায় ঢুকল। শ্বশুরের সঙ্গে তার কথাবার্তা হল মামুলি ধরনের। সে এদিকে তেমন আসে না কেন? ছেলেটি এখানে আছে সে কারণেও তো আসা উচিত। এবং ছেলেটিকে নিজের কাছে মাঝেমধ্যে রাখা উচিত।