জেরিন গেল না। কোলের ওপর দুহাত রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রইল। জেরিনের সঙ্গে তারিনের কোনো মিল নেই। দুজন সম্পূর্ণ দু রকম। তবুও এরা দুজন যে বোন তা যে-কেউ ধরতে পারবে। অতি সূক্ষ্ম সাদৃশ্য। তা-ও বা কী করে হয়, সূক্ষ্ম সাদৃশ্য হলে চট করে এরা যে দু বোন তা বলা যায় কি করে? জেরিনের মধ্যে এক ধরনের কাঠিন্য আছে। সে খানিকটা অহংকারী। অহংকার তার চরিত্রের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। চার ভাইবোনের মধ্যে জেরিন সবচেয়ে মেধাবী। মেট্রিক থেকে শুরু করে অনার্স পর্যন্ত চোখ-ধাঁধানো রেজাল্ট করেছে। অনার্স প্রথম নিয়েছিল জিওগ্রাফিতে। সেটা বদলে নিয়েছে স্ট্যাটিসটিক্স। তা-ও নাকি কার ওপর রাগ করে। শুধুমাত্র দেখানোর জন্যে অঙ্কে মেয়েদের মাথা পুরুষদের চেয়ে খারাপ নয়। তা সে দেখিয়েছে।
কি ব্যাপার জেরিন ঘুমুতে যাচ্ছ না যে?
যাব খানিকটা ভদ্রতা করে নিই। আফটার অল বড় বোনের হাসব্যান্ড, অভদ্রতা করি কিভাবে? এ-বাড়ির জামাই।
জেরিন অল্প-অল্প পা দুলাচ্ছে। কাঠিন্য ও স্নিগ্ধতা মেশানো একটা মুখ দেখতে ভালো লাগে। আহসান বলল,
মারুফ আছে কেমন?
ভালো আছে বলেই তো মনে হয়। অবশ্যি আমি ঠিক বলতে পারব না। মা বলতে পারবেন। ওর দেখাশোনা মা করেন। আমার এত সময় নেই।
পড়াশোনা?
হুঁ। তাছাড়া আপনার পুত্র আমাকে দেখতে পারে না। ঐদিন ভুলিয়ে-ভালিয়ে আমার কাছে এনে শুইয়েছি। মাঝরাতে একা-একা বালিশ নিয়ে উঠে চলে গেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমিও ছড়বার পাত্র না। আমি আবার তুলে নিয়ে এলাম। আবার ঘুম ভেঙে একা-একা চলে গেল।
তুমি কি করলে? আবার নিয়ে এলে?
ঠিক ধরেছেন। অন্য কেউ হলে এটা করত না, হাল ছেড়ে দিত। আমি এত সহজে হাল ছাড়ি না।
খুব ভালো গুণ।
ভালো মন্দ জানি না। আমি যেরকম সেরকম। সব মানুষই আলাদা। আপা ছিল আপার মতো। আমি হয়েছি আমার মতো।
ফিলসফি করছ?
ফিলসফি-টফি না। আমি এইসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আজকাল ভাবি।
প্রেমেট্রেমে পড়লে মেয়েরা এইসব ভাবে। ঘটেছে সেরকম কিছু?
না। সবাই কি আর আপা?
আহসান কাল তীক্ষ চোখে। জেরিন তার আপার প্রেমের প্রসঙ্গটি অত্যন্ত কঠিনভাবে মাঝেমধ্যে আনে। মনে হয় কোনো বিচিত্র কারণে এই বিষয়টি নিয়েই তারিনের ওপর তার চাপা রাগ আছে। যে-মেয়েটি বেঁচে নেই তার ওপর এতটা রাগ এখনো থাকা খুব অন্যায়।
দুলাভাই।
বল।
আমার মাঝে-মাঝে জানতে ইচ্ছে করে আপনাকে আপা এতটা পছন্দ করেছিল কেন? ভালো লাগার মতো সত্যি কি কিছু আছে আপনার মধ্যে?
না নেই।
আসলেই কিন্তু নেই। প্রাইভেট কলেজে মাস্টারি করেন। হেনতেন করে একটা সেকেন্ড ক্লাস পেলেই প্রাইভেট কলেজের মাস্টারি যোগাড় করা যায়। যায় না?
হ্যাঁ যায়।
আপনার চেহারা ভালো না। গান জানেন না, খেলাধুলা জানেন না। দরিদ্র পরিবারের ছেলে। ভুল বলছি?
না।
কি দিয়ে আপাকে ভুলিয়েছিলেন? কাইন্ডলি একটু বলুন শুনি। আমি প্রায়ই ভাবি আপনাকে জিজ্ঞেস করব। জিজ্ঞেস করা হয় না। মনে থাকে না।
আহসান সিগারেট ধরাল। এক টুকরো সন্দেশ ভেঙে মুখে দিল। জেরিন নিচু গলায় বলতে লাগল, বড় আপা এবং আমি এক খাটে ঘুমুতাম। বুঝলেন দুলাভাই, আপনি সেই সময় বড় বড় চিঠি লিখতেন আপাকে। আমি ঘুমিয়ে পড়তেই আপা অসংখ্যবার পড়া চিঠি আবার পড়তে বসত।
বুঝতে কী করে? তুমি তো ঘুমে।
না ঘুমে না। ঘুমের ভান। আপা সেই সব আজেবাজে চিঠি পড়ে খুব কাঁদত। এমন রাগ লাগত আমার।
আজেবাজে বলছ কেন?
আজেবাজে বলছি কারণ ঐসব চিঠি আমি লুকিয়ে পড়েছি। নিতান্তই হালকা কথাবার্তা। বানানো সব ব্যাপার। আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম বিয়ের পর-পর আপা একটা। শক খাবে। দেখবে এইসব প্রেমট্রেমের ব্যাপারগুলো সত্যি না।
তোমার কি মনে হয় শক খেয়েছিল?
না বিয়ের পর আপা আরো অন্যরকম হয়ে গেল। যেন পৃথিবীতে আপনি ছাড়া দ্বিতীয় মানুষ নেই। আমি ভীষণ আহত হয়েছিলাম।
পাস্ট টেন্সে কথা বলছ, তার মানে কী এই যে এখন আহত হচ্ছ না?
এখনো হচ্ছি। হচ্ছি বলেই আপনাকে জিজ্ঞেস করছি। কি দিয়ে তাকে ভুলিয়েছিলেন?
কিছু দিয়েই তাকে ভুলাই নি। সে ভুলেছে নিজ গুণে।
আমারও তাই মনে হয়। আপা আপনাকে বিয়ে না করে যদি অন্য কাউকে বিয়ে হলেও একই অবস্থাই হত। তার চিন্তা-চেতনা জুড়ে থাকত ঐ লোকটি।
সেটা কি খুব খারাপ?
হ্যাঁ খারাপ। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব আইডেনটিটি থাকবে। মেয়ে মানেই কি লতানো গাছ? যে অন্য কাউকে না জড়িয়ে বেঁচে থাকতে পারবে না?
পারবে না কেন, নিশ্চয়ই পারবে। তুমি যে অন্তত পারবে এই সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।
ঠাট্টা করছেন?
না ঠাট্টা করছি না। তুমি খুবই স্পিরিটেড মেয়ে। তোমার এই স্পিরিট দেখতে ভালো লাগে।
আর আপার কোন জিনিসটা দেখতে ভালো লাগত?
আহসান উত্তর দিল না। জেরিন বলল, বলুন না শুনি। আচ্ছা ঠিক আছে উল্টোটা বলুন আপার কোন জিনিসটা আপনার খারাপ লাগত?
ঐ প্রসঙ্গ থাক। অন্য কিছ নিয়ে আলাপ করি শোন। তোমার ঘমের কি হল?
জেরিন জবাব দিল না। কি যেন সে ভাবছে। তার কপাল কুঁচকানো, মুখের ভাব চিন্তাক্লিষ্ট। গরমে নাক ঘেমেছে। সুন্দর লাগছে দেখতে। তারিনেরও নাক ঘামত।
দুলাভাই।
বল।
আপনার সঙ্গে আমার একটি অত্যন্ত জরুরি কথা আছে।
এতক্ষণ যা বললে সেগুলো জরুরি নয়?
না নয়।
বেশ, বল শুনি।
বলছি–কিন্তু আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার জরুরি কথাটা বলা শেষ হবার পরেও আগে যেভাবে আসতেন এ-বাড়িতে ঠিক এইভাবেই আসবেন।