আচ্ছা এখন যাই?
বেগম জবাব দিল না।
বাড়ির সামনে ট্রাক দাঁড়িয়ে। জলিল মিয়া বারান্দায় বসে আছে। তার হেল্লার বালতি-বালতি পানি এনে ট্রাকের চাকায় ঢালছে। এই হেল্পারটিকেই বোধ হয় কুকুর কামড়েছে। বাঁ পায়ে পট্রি বাঁধা। সে কিছুক্ষণ পর-পর থুথু ফেলছে। আগেও ফেলত-নাকি কুকুর কামড়ানোর পর ফেলছে কে জানে। জলিল বলল, স্লামালিকুম প্ৰবেসর সাহেব।
ওয়ালাইকুম সালাম।
ঝামেলা দেখেন না, এই বিপদের মধ্যে ট্রিপে যাওয়া লাগবে। বগুড়া। পার্টির সাথে কথাবার্তা বলা। না গেলে হবে না।
ও।
হেল্পার হারামজাদার শরীরটাও ভালো না। ইনজেকশন দেওয়া লাগবে। আপনি যান কোথায়?
নিউমার্কেটের দিকে যাব।
একটু বসেন ট্রাক নিয়া বার হব। নামায়ে দিব আপনারে।
না লাগবে না।
আমাদের দেরি হইত না।
কোনো দরকার নেই। শ্যামলীতে আমার একটা কাজ আছে।
ও আচ্ছা। যান তাহলে। স্লামালিকুম।
আহসানরাস্তায় নেমে পড়ল। রাস্তায় প্যাচপেচেকাদা। ইট বিছানোরাস্তা। জায়গায়জায়গায় ইট উঠে গিয়ে গর্ত হয়েছে। পানি জমে আছে। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। প্রয়োজনের চেয়েও অনেক বেশি মানোযোগ দিয়ে সে রাস্তা দেখছে। মনে-মনে সে কিছু একটা খুজছে। যা খুঁজছে তা সে পেয়ে গেল।
রাস্তার একপাশে ঘাসের ওপর এক পাটি স্যান্ডেল। রেবা কিংবা পারুল নামের মেয়েটির স্যান্ডেল। যাবার সময় বোধ হয় বোরির চোখে পড়ে নি। লাল ফিতার নতুন স্যান্ডেল, হয়ত অল্প কিছুদিন হল কিনেছে। আহসান লক্ষ করল তার মন খারাপ লাগছে। অথচ মন খারাপ হবার মতো কিছুই হয় নি। এই মেয়েটিকে এক রাতের জন্যে সে আশ্রয় দিয়েছিল। রাত কেটে গেছে সে চলে গেছে, ব্যস ফুরিয়ে গেল কিন্তু এখন এমন লাগছে কেন? শুধু যে এখন এমন লাগছে তাই না, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যখন দেখেছে মেয়েটি চলে গিয়েছে তখনি বুকে আচমকা একটা ধাক্কা লেগেছিল।
যা সে প্ৰাণপণে অস্বীকার করেছে। কিন্তু কেন? এরকম হচ্ছে কেন? আহসান একটি সিগারেট ধরাল। কার্যকারণ ছাড়া এই পৃথিবীতে কিছুই হয় না। সে কি কার্যকারণ ছাড়াই একটি স্যান্ডেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে? নিশ্চয়ই না। কারণ একটি আছে যা স্বীকার করতে তার ইচ্ছে করছে না। রেবা বা পারুল নামের মেয়েটির সঙ্গে তারিনের চেহারার খুব মিল। প্রথম দিকে চোখে পড়ে নি কিন্তু মেয়েটি যখন তারিনের শাড়ি পরে বেরুল তখন আহসানের গা কাঁপছিল। কী অদ্ভুত মিল। কী অসম্ভব ব্যাপার? তখন তা সে স্বীকার করে নি। রূঢ় ব্যবহারই করেছে মেয়েটির সঙ্গে। খেতে বলেছে অবশ্যি। সেই বলায় মমতা বা করুণা ছিল না। কিংবা থাকলেও তার প্ৰকাশ হয় নি। প্রকাশ হলে ক্ষতি ছিল না কিছু।
কড়া রোদ উঠেছে। আহসান হাঁটছে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে। তার তেমন কোনো। পরিকল্পনা নেই। কোন একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে হবে। এই পর্যন্ত। বিকেলের জন্যে আরেকটা ঝামেলা বেধে রয়েছে। হাসপাতালে যেতে হবে।
শ্যামলী থেকে সে একটা বাসে উঠল। প্রায় ফাঁকা বাস। বাসে চড়লেই তার কেমন ঝিমুনির মতো আসে। আজ আসছে না। এত খালি সিট থাকতেও নোংরা এক বুড়ো এসে বসল তার পাশে। বুডোর হাতে পলিথিনের ব্যাগে কিছু ছোট মাছ। বিকট গন্ধ আসছে সেখান থেকে। হঠাৎ করেই আহসানের মনে হল পলিথিনের একটা ব্যাগ থাকলে স্যান্ডেলটা নিয়ে আসা যেত। কোনোদিন এ-মেয়েটির সঙ্গে দেখা হলে ফিরিয়ে দেওয়া যেত। সে নিশ্চয়ই অন্য পাটিটি যত্ন করে রেখেছে।
বুডোর পলিথিনের ব্যাগ থেকে টপটপ করে মাছের রস পড়ছে। এক ফোঁটা পড়ল আহসানের প্যান্টে উঠে অন্য কোথাও বসা উচিত কিন্তু উঠতে ইচ্ছে করছে না।
দরজা খুলে জেরিন বিরক্ত গলায় বলল, দুলাভাই আপনি সবসময় অড আওয়ারে আসেন কেন? ছুটির দিনে আড়াইটার সময় কেউ আসে?
আহসান হাসল।
আসুন ভেতরে আসুন। কাঁচাঘুম ভাঙিয়েছেন ভীষণ রাগ লাগছে।
সরি। বাসায় আর কেউ নেই?
বাবা আছেন। ঘুমুচ্ছেন। মা আপনার পুত্রকে নিয়ে মেজোপার বাসায়। আপনি খেয়ে এসেছেন নিশ্চয়ই?
হুঁ।
জেরিন হাই তুলে বলল, চোখটা শুধু লেগে এসেছে এমন সময় কলিং বেল টিপলেন। এরকম অসময়ে ফকির-মিসকিনরা এসে কলিং বেল টিপে ভিক্ষা চায়। বুঝলেন সাহেব?
বুঝলাম।
কাঁচাঘুম ভাঙলে কি যে খারাপ লাগে।
দুপুরে ঘুমের অভ্যাসটা বাদ দাও। হু-হু করে মোটা হয়ে যাবে। পাত্র জুটবে না।
চা খাবেন? চা করতে হবে?
না হবে না। ফ্ৰিজে ঠাণ্ডা কিছু আছে?
পানি আছে। পানি দিতে পারি।
তা-ই দাও।
জেরিন পানি আনল সঙ্গে একগ্লাস সরবত। দুটি হিমশীতল সন্দেশ এবং একটুকরো কেক।
ফ্রিজে যা পেয়েছি নিয়ে এসেছি। কেকটা বাসি। ওটা খাবেন না।
বাসি তো আনলে কেন?
প্লেটের শোভা বাড়াবার জন্যে। দুলাভাই, সরবত-টাবত খেয়ে রেস্ট নিন। আমি ঘুমুতে চললাম। সন্ধ্যাবেলা দেখা হবে।
সত্যি-সত্যি যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ সত্যি-সত্যি যাচ্ছি। আপনার ওপর দুটি দায়িত্ব কেউ কলিং বেল টিপলে দরজা খুলবেন। টেলিফোন এলে ধরবেন এবং বলবেনবাসায় কেউ নেই, সন্ধ্যার পর ফোন করুন।
আচ্ছা ঠিক আছে—তুমি যাও।
রেস্ট নিতে চাইলে রেস্ট নিতে পারেনবিছানা দেখিয়ে দিচ্ছি। আর যদি জেগে থাকতে চান কিছু ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন দিতে পরি। omni বলে একটা চমৎকার ম্যাগাজিন আছে। সায়েন্স ফিকশান ম্যাগাজিন।
কিছু লাগবে না।
বসে-বসে ধ্যান করবেন?
ঝিমুব। ঝিমুতে ইচ্ছে করছে। তুমি যাও, তোমাকে বসে থাকতে হবে না।