সম্রাটের প্রধান খেলা এখন হলো পাখির সঙ্গে সময় কাটানো। কম্ব বিজয়ের পর সম্রাট তোতাকে জিজ্ঞেস করলেন, কে শ্ৰেষ্ঠ আমি না বাহাদুর শাহ?
তোতা বলল, আল্লাহ আকবর।
পাখির মতে আল্লাহই শ্রেষ্ঠ। সম্রাট সন্তোষ লাভ করলেন। তোতাকে স্বর্গীয় পক্ষী উপাধি দিলেন। তার জন্যে সোনার খাঁচা বানানোর নির্দেশ দিলেন।
সম্রাটকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্বে নিযুক্ত জওহরকে এই পক্ষীর সেবক নিয়োগ করলেন। (এই জওহর সম্রাট হুমায়ূনের একটি জীবনী রচনা করেন। সম্রাটভগ্নি গুলবদনের পরেই জওহরের জীবনীকে প্রামাণ্য ধরা হয়।) সম্রাটের নির্দেশে এই তোতাপাখির একটি ছবি আঁকা হয়। ছবিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে এখনো সংরক্ষিত আছে।
লু হাওয়া বইছে
জুন মাস। আগ্রার উপর দিয়ে কয়েকদিন ধরেই লু হাওয়া বইছে। পিঙ্গল আকাশে মেঘের দেখা নেই। লোকজন দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে বসা। কিছু মিঠাইয়ের দোকান খোলা। মিঠাইয়ের উপর ভিনভন্ন করছে মাছি। গরম কাল মাছিদের প্রিয় সময়। গরমে তারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।
আগ্রার পথেঘাটে ময়ুরের ঝাঁক। তাদের দৃষ্টি আকাশের দিকে। তারা কুৎসিত শব্দে ডাকে, চক্রাকারে ঘোরে, একে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গরমে এদেরও মাথা খারাপের মতো হয়ে গেছে। ময়ুর পেখম মেলার জন্যে অস্থির। বৃষ্টির দেখা নেই বলে পেখম মেলতে পারছে না।
আগ্রার অধিবাসীরা আজ খানিকটা উত্তেজিত। প্ৰধান কাজির নির্দেশে তিন অপরাধীর শাস্তি হবে। বিশেষ ধরনের শাস্তি বলেই উত্তেজনা। তিনি অপরাধীর জন্যে তিনটি গাধা হত্যা করা হয়েছে। গাধাগুলির চামড়া ছিলানো হয়েছে। অপরাধীদের গাধার চামড়ার ভেতর ঢুকিয়ে চামড়া সেলাই করে দেওয়া হবে। তারপর তাদের শুইয়ে দেওয়া হবে ঘোড়ার গাড়িতে। এই গাড়ি আগ্রা শহরময় ঘুরবে। প্রচণ্ড গরমে গাধার চামড়া এঁটে বসে যাবে অপরাধীদের গায়ে। তাদের মৃত্যু হবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে।
তিন অপরাধী গাধার চামড়ায় মোড়া অবস্থায় ঘোড়ার গাড়ির পাটাতনে শুয়ে আছে। ঘোড়ার গাড়ি চলছে। ঘোড়ার গাড়ির চালকের হাতে রুপার ঘণ্টা। সে মাঝে মাঝে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। ঘণ্টাধ্বনি শাস্তির ঘোষণা। প্ৰচণ্ড গরমে গাধার চামড়া অপরাধীদের গায়ে ঐটে বসছে। তাদের একজন পানি পানি’ বলে অস্ফুট শব্দ করছে। গাড়ির পেছনে এক দঙ্গল ছেলেপুলে। তাদের উৎসাহের সীমা নেই। তারা মাঝে মাঝে ঢ়িল ছুড়ছে। যখনই কোনো ঢ়িল গাধার চামড়ায় আবৃত অপরাধীদের উপর পড়ছে, তখনই তারা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছে।
গরম অসহনীয় বোধ হওয়ায় সম্রাট গোসলখানায় দরবারে খাস’ বসিয়েছেন। তাঁর প্রিয় অমাত্যরা গোসলখানায় জড়ো হয়েছেন। সম্রাট হাম্মামে বুক পর্যন্ত ড়ুবিয়ে বসে আছেন। দুজন খোজা বালক মাঝে মাঝে তার মাথায় পানি ঢালছে। পানিতে গোলাপগন্ধ। অসংখ্য গোলাপ পাপড়ি ছড়িয়ে পানিতে এই গন্ধ আনা হয়েছে। বিশেষ ব্যবস্থায় পানি শীতল করা হয়েছে। শীতলকরণ-পদ্ধতি চালু আছে। সম্রাট যতক্ষণ হাম্মামে থাকবেন ততক্ষণ এই প্রক্রিয়া চলবে।
পানির শীতলকরণ-পদ্ধতি যথেষ্টই বৈজ্ঞানিক। বাষ্পীভবনের সময় পানি কিছু উত্তাপ নিয়ে বাম্পে পরিণত হয়। উত্তাপ নেওয়ার কারণে পানি ঠাণ্ডা হয়। প্ৰকাণ্ড সব মাটির জালার গায়ে পানি ঢেলে বাতাস দেওয়া হচ্ছে। এতে বাষ্পীভবন-প্রক্রিয়া দ্রুত হচ্ছে।
সম্রাটকে ঘিরে আছেন দরবারে খাসের অমাত্যজন। মন্ত্রীসভার সকল সদস্য আছেন। দুজন সেনাপতি আছেন। আজকের দরবারে খাসে আফগান শের খাঁর বিষয়ে আলোচনা হবে। শের খাঁ শক্তি সঞ্চয় করেই যাচ্ছে। তার বিষয়ে কখন কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা সম্রাট বলবেন। আলোচনায় অন্যরাও অংশ নিতে পারবে, তবে কে অংশ নেবে। তা সম্রাট আঙুলের ইশারায় ঠিক করবেন। ইচ্ছামতো মতামত জাহির করার সুযোগ নেই। গোপন আলোচনা খোজাদের সামনেই হচ্ছে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। গোসলখানায় উপস্থিত সব খোজাই বধির। কানে গলন্ত সীসা ঢেলে তাদের কান নষ্ট করা হয়েছে।
সভা শুরুর আগে আগে সম্রাট একটি শের আবৃত্তি করলেন—
মুরাদই লাখ বুড়া চাহে তো কেয়া হোতা হ্যায় ওই হোতা হ্যায় যো মঞ্জরে খোদা হোতা হ্যায়। (শত্রুরা আমার যতই অনিষ্ট কামনা করুক তাতে কিছুই হবে না। ঈশ্বর যা মঞ্জুর করবেন তা-ই হবে আমার ভাগ্যলিপি।)
দরবারিরা একসঙ্গে বললেন, মারহাবা! মারহাবা! সম্রাট হাসলেন। দ্বিতীয় শের আবৃত্তি করলেন—
হর মুসিবৎকো দিয়া এক তবসুমসে জবাব ইসতরাহ গরদিসে দৌড়োকে রুলায়া হ্যায় ম্যায়নে। (দুর্দিন ভেবেছিল সে আমাকে কাদাবে। উল্টা হাসিমুখে আমি তাকে কাঁদিয়েছি।)
আবারও আওয়াজ উঠল, মারহাবা! মারহাবা!
প্রধান উজির বললেন, গোস্তাকি মাফ হয়। এই অপূর্ব শের কার কলম থেকে বের হয়েছে?
সম্রাট বললেন, এই শের তোমাদের বাদশাহর কলম থেকে এসেছে। সে হিন্দুস্থানের বাদশাহ হলেও অন্তরে একজন অক্ষম দুর্বল কবি।
প্রধান উজির কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, সম্রাট ইশারায় তাঁকে থামিয়ে সভা শুরু করলেন। এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে অমাত্যদের মধ্যে গৌণ একজনকে হাম্মামে নামতে বললেন। সম্রাটের সঙ্গে স্নান করা পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। যাকে হাম্মামে নামতে বলা হলো, তাঁর চেহারা অতি সাধারণ। মধ্যম আকৃতির কৃশকায় একজন মানুষ। তাঁর নাম বৈরাম খাঁ। (মোঘল ইতিহাসের প্রধান পুরুষদের একজন।) গোসলখানায় যখন দরবারে খাস বসে তখন উপস্থিত সবাই পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়ে আসে। যেন সম্রাটের হুকুম পাওয়ামাত্র পানিতে নামতে পারে।