বাহাদুর শাহ পালিয়ে মাণ্ডু দুর্গে আশ্রয় নিলেন।
হুমায়ূন মাণ্ডু পৌঁছালেন ত্ৰিশ হাজার অশ্বারোহী নিয়ে। তিনি মাণ্ডু দুর্গ অবরোধ করলেন। সারা দিন ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছিলেন ক্লান্ত। এশার নামাজ শেষ করে সেনাপতিদের ডেকে বললেন, আমি জানি মাণ্ডু দুর্গ দখল করা কঠিন। কিন্তু আমি বাহাদুর শাহকে ধরতে চাই। এমন ব্যবস্থা করা হোক যেন রাতের ভেতর দুর্গ দখল হয়।
লম্বা লম্বা মই তৈরি করা হলো। মই দুর্গের গায়ে লাগিয়ে তীরন্দাজরা দুর্গপ্রাচীরে উঠে গেল। একদল তীরন্দাজ দুর্গের প্রধান দরজা খুলে দিল।
বাহাদুর শাহ দড়ি বেয়ে দুর্গ থেকে পালিয়ে গেলেন। দুর্গের ভেতরের মানুষজন কেউ বলল না, বাহাদুর শাহ কীভাবে পালিয়েছেন কোন দিকে যাচ্ছেন। হুমায়ূন তখন এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন, গাঢ় লাল রঙের পোশাক পরলেন। এর অর্থ, সবাইকে হত্যা করো।
ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো। মোঘল সৈনিকের তলোয়ারের নিচে হাজার হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হলো। সেদিন মঙ্গলবার হওয়ায় রক্তাম্বর পরে হুমায়ূন উন্মাদ হয়ে গেলেন। তাকে দেখে তার সৈন্যরাও উন্মাদ হয়ে গেল।
মাণ্ডুবাসীদের যে রক্ষা করে, তার কথা এখন বলা যাক। তার নাম বচ্ছু (মতান্তরে মঞ্চ)। এই বচ্ছু বাহাদুর শাহ’র অতি প্রিয় এক গায়ক। বাহাদুর শাহ যেখানে যান। সেখানেই সে যায়।
রক্তাম্বর পরা সম্রাট হুমায়ূনের দিকে বচ্ছু গান গাইতে গাইতে এগিয়ে গেল। গানের কথা—রক্তের রঙের চেয়ে বৃক্ষের সবুজ রঙ কি কম সুন্দর?…
হুমায়ূন গায়কের কণ্ঠ শুনে অভিভূত হলেন। তাঁর কাছে মনে হলো, তিনি তাঁর জীবনে এত মধুর সঙ্গীত শোনেন নি। বচ্ছু সম্রাটের সামনে দাঁড়াল। সম্রাট বললেন, তুমি কি জানো যে তুমি এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গায়ক?
বচ্ছু বলল, জানি। আমি তোমার জাদুকরী ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছি। বলো কী চাও? আমি চাই আপনি পোশাক বদলে সবুজ পোশাক পরুন। সম্রাট সবুজ বস্ত্র পরলেন। হত্যাযজ্ঞ সঙ্গে সঙ্গে থামল। সম্রাট বললেন, তুমি আর কী চাও?
বচ্ছু বলল, যারা বন্দি আছে তাদের মুক্ত করে দিন। হুমায়ূন বললেন, সবাই মুক্ত। আমি তোমার আরও একটি ইচ্ছা পূর্ণ করব। বলো কী চাও?
আমি আমার গুরু বাহাদুর শাহের কাছে যেতে চাই।
হুমায়ূন দুর্গের প্রধান ফটক খুলে বচ্ছুকে চলে যেতে দিলেন। হুমায়ূনের প্রধান উজির বললেন, আপনি কী করছেন?
সম্রাট বললেন, এই গায়ক যদি আমার রাজ্য প্রার্থনা করত। আমি তাকে দিয়ে দিতাম।
মাণ্ডু থেকে পালিয়ে বাহাদুর শাহ আহমেদাবাদের চম্পানী দুর্গে অবস্থান নিলেন। মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। বাহাদুর শাহের গোলন্দাজবাহিনী কামান বসানোর আগেই সম্রাট হুমায়ূন চম্পানীর দুর্গ অবরোধ করলেন। বাহাদুর শাহ আবার পালালেন, তিনি আশ্রয় নিলেন কম্ব দুর্গে। হুমায়ূন এক ঘণ্টার মধ্যে কম্ব দুর্গে উপস্থিত হলেন।
কম্ব দুর্গ থেকেও বাহাদুর শাহকে পালাতে হলো। এবার তার সঙ্গে গায়ক বচ্ছু। পালাবার সময় তিনি বলেছিলেন, আমার সঙ্গে বচ্ছু আছে আমার আর কিছুই লাগবে না।
হুমায়ূন দুর্গের ভেতর মাগরেবের নামাজ পড়লেন। নামাজের শেষে তার ইমামকে ডেকে পাঠালেন। ইমামকে বললেন, মাগরেবের নামাজে আপনি সূরা ফিল পাঠ করেছেন?
ইমাম বললেন, জি জনাব।
সূরা ফিলের শানে নজ্বল এবং তর্জমা আমাকে শোনান।
ইমাম বললেন, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে নবীয়ে করিম (দঃ)-এর জন্মবর্ষের ঘটনার বর্ণনা নিয়ে এই সূরা নাযেল হয়। ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা হস্তীবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ করেছিলেন, তখন আল্লাহর আদেশে ছোট ছোট আবাবিল পাখি দিয়ে ইয়েমেনের বাদশাহকে পরাস্ত করা হয়েছিল। সূরা ফিলের এই হলো ঘটনা। আল্লাহ্পাক বলেছেন, হে রসুল! তুমি কি দেখো নি তোমার আল্লাহ হাতিওয়ালাদের সাথে কেমন আচরণ করলেন? তাদের সমস্ত আয়োজন কি আল্লাহ ব্যর্থ করে দেন নি?
সম্রাট বললেন, আপনি আমাকে ইয়েমেনের বাদশাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্যে এই সূরা পাঠ করেছেন?
ইমাম বললেন, আমার ভুল হয়েছে। সম্রাট বললেন, আপনি বাহাদুর শাহর অনুরক্ত বলেই এই কাজটি করলেন। কী আশ্চর্য, আমার প্রধান শক্রর প্রতি যে অনুরক্ত, আমি তার পেছনে দিনের পর দিননামাজ পড়েছি!
হুমায়ূন আবার রক্তপোশাক পরলেন। বাহাদুর শাহ তাঁকে যে হাতিটি দিয়েছেন কুশ তিনি সেই হাতি আনতে বললেন। হাতি হাজির করা হলো।
সাম্রাট বললেন, আজ মাগরেবে যে সূরা পাঠ করা হয়েছে তার নাম ফিল অর্থাৎ হাতি ইমাম, আপনার প্রয় বাহাদুর শহর দেওয়া সেই হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট করে আমি আপনাকে হত্যার নির্দেশ দিলাম। এই আদেশ এশার নামাজের আগেই যেন কার্যকর হয়। (*ঐতিহাসিক আবুল ফজল লিখেছেন, এই ঘটনার পর হুমায়ূন অত্যন্ত অনুতপ্ত হন। তিনি সারা রাত একফোঁটা ঘুমাতে পারেন নি। সারা রাত শিশুর মতো কেঁদেছেন। পরদিন ফজরের নামাজের আগে তিনি তার রক্তপোশাক পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। বাকি জীবন তিনি আর এই ভয়ঙ্কর বস্ত্ৰ পরিধান করেন নি।)
নির্দেশ কার্যকর করা হলো।
কম্ব দুর্গ থেকে বাহাদুর শাহ পালিয়ে গেলেও তাঁর ধনরত্ন নিতে পারলেন না। সবই হুমায়ূনের হাতে পড়ল। ধনরত্নের বাইরে পেলেন বাহাদুর শাহের পোষা তোতাপাখি।
এই পাখি নাকি ভবিষ্যৎ বলতে পারে। রুমী খাঁকে সে যতবার দেখে ততবারই বলে, ফট রুমী হারামখোর। ফট রুমী হারামখোর। এর অর্থ হারামখোর রুমীর উপর অভিসম্পাত।