এই সিদ্ধান্ত সমরবিশারদদের সঙ্গে আলোচনার পর নিন।
সমরবিশারদরা আপনার মতোই কথা বলবে। কিন্তু আমি আমার বিপদগ্ৰস্ত বোনের পাশে দাঁড়াতে চাই।
শাহানশাহ, রাজনীতিতে আবেগের স্থান নেই।
হুমায়ূন বললেন, আমার রাজনীতিতে আছে। একজনের চরম বিপদে আমি তার পাশে যখন দাঁড়াব, তখন দেখা যাবে আমার চরম বিপদেও কেউ একজন আমার পাশে এসে দাড়াবে। (* হুমায়ূনের কথা সত্যি হয়েছিল। রাজ্যহারা পথের ফকির হুমায়ূনকে সাহায্য করেছিলেন পারস্য সম্রাট। সেখানেও একটি চিঠির ভূমিকা ছিল।)
প্রধান উজির বিরক্তি চাপার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। সম্রাটের কোনো কর্মকাণ্ডই সম্রাটসুলভ না। তিনি বাস করেন সম্পূর্ণ নিজের জগতে। সেই জগৎ নিয়ন্ত্রণ করে সুরা, আফিম এবং কবিতা। তুরস্ক থেকে এক কবি এসেছে, রাজসভায় তাকে উচ্চস্থান দেওয়া হয়েছে। কবির নাম দিদির আলী।
সম্রাট গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করাকে এখন রাজকার্যের অংশ ভাবছেন। সারাক্ষণ শুভ-সময় অশুভ-সময় নির্ণয় করে চলেছেন। তিনি পোশাকও পরছেন গ্রহ-নক্ষত্র বিবেচনা করে। রবিবারে পরছেন। হলুদ পোশাক। সেদিন তিনি রাজ্য পরিচালনা-বিষয়ক সভা করেন।
সোমবার পরেন সবুজ পোশাক। ঐদিন তিনি আনন্দে থাকেন। রাজসভায় গীত-বাদ্য হয়।
মঙ্গলবারে লাল, মঙ্গলগ্রহের লাল রঙের পোশাক পরেন। সেদিন যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর মেজাজ থাকে উগ্র। সামান্য অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেন।
আজ মঙ্গলবার। সম্রাট লাল পোশাক পরেছেন। যুদ্ধযাত্রা ঘোষণা দেওয়ার এইটিই কি কারণ?
প্রধান উজির আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সম্রাট তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তীর ধনুক নিয়ে আসুন। একটি তীরের আগায় বাহাদুর শাহর নাম লেখা থাকবে। আরেকটির আগায় আমার নাম। আমি নিজে তীর ছুড়ে দেখব কোনটি আগে যায়। যার তীর আগে যাবে, সে-ই যুদ্ধে জিতবে।
সম্রাটের তীর অনেক আগে গেল।
পরদিন (বুধবার) ফজরের নামাজের পর হুমায়ূন চিতোরের দিকে সসৈন্যে রওনা হলেন। দুপুরে এক হিদের পাড়ে সৈন্যরা দ্বিপ্রহরের খাবারের জন্যে থামল। তখন বাহাদুর শাহ্র বিশেষ দূত সম্রাট হুমায়ূনের কাছে একটি চিঠি দিলেন। চিঠিতে লেখা—
সম্রাট হুমায়ূন,
অতি ভক্তিভরে নিবেদন করছি যে, আমি মোঘল সম্রাটের একজন দীন সেবক মাত্র। আমি বর্তমানে ধৰ্মযুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছি। ওলেমারা রানী কর্ণাবতীর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধকে জেহাদ অ্যাখ্যা দিয়েছেন।
সম্ভবত আপনার কাছে তথ্য নাই যে, এই দুর্গে অনেক মুসলমান রমণী বন্দি অবস্থায় আছেন। রাজপুত পুরুষরা তাদের ব্যবহার করে।
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের নৃত্যগীত এবং আরও অনেক অশ্লীল কুৎসিত কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়।
আমি অনুরোধ করব যে, আপনি এই যুদ্ধযাত্রা স্থগিত করবেন। আমি আপনার সম্মানে এক বাক্স মণিমুক্তা, চারটি আরবি ঘোড়া এবং একটি হাতি পাঠালাম। এই হাতিটা আমার প্রিয়, এর নাম কুশ।
ইতি
আপনার সেবক
বাহাদুর শাহ
হুমায়ূন যুদ্ধযাত্রা স্থগিত করলেন না। জোহরের নামাজের পর সেনাবাহিনী দ্রুত অগ্রসর হতে লাগল। বাহাদুর শাহ খবর পেলেন হুমায়ূন যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন। তিনি সঙ্গে করে এনেছেন তাঁর গোলন্দাজ বাহিনী। গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান তিকি খাঁ কামান চালনায় বিশেষ পারদর্শী। হুমায়ূনের বিশেষ কামান ফিরোজাকে দুটা হাতি টেনে নিয়ে আসছে। মাঝারি। কামানগুলি টানছে মাদ্রাজি বলদ। বন্দুকধারীরা কামানের সঙ্গে সঙ্গে আসছে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে কামান অগ্রসর হবে না, তবে বন্দুকধারীরা অগ্রসর হবে।
সম্রাটের তীরন্দাজ বাহিনীর নেতৃত্বে আছে আফগান তীরন্দাজ প্রধান শাহ জুম্মা। তাঁর সম্পর্কে কথিত আছে, লক্ষ্যবস্তু দেখার পর তিনি চোখ বন্ধ করে তীর ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করতে পারেন।
হুমায়ূনের অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ছিল ত্ৰিশ হাজার। তারা অগ্রবর্তী তীরন্দাজ দলের পেছনে পেছনে যাচ্ছিল।
বাহাদুর শাহ সম্রাট হুমায়ূনের দ্রুত এগিয়ে আসার খবর শুনলেন। তিনি পালিয়ে যাওয়ার সব প্রস্তুতি শেষ করে দুর্গ অবরোধকারী সৈন্যদের উল্লাসধ্বনি করতে বললেন। দুর্গের বাইরে বিরাট হৈচৈ হতে লাগল।
রানী কর্ণাবতী বাইরে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয়েছে কেন জানতে বাহিনীর যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে হুমায়ূন পরাজিত হয়েছেন। হাতির পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছেন বলেই বাহাদুর শাহর শিবিরে আনন্দ উল্লাস।
জহরব্রত পালনের জন্যে আগুন প্রস্তুত ছিল। রানী কর্ণাবতী সবাইকে নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রানীর আদেশে দুর্গের তিন হাজার শিশুকেও কুয়ায় নিক্ষেপ করা হলো। যেন এরা শত্রুর হাতে পড়ে নিগৃহিত না হয়।
বাহাদুর শাহ দুর্গে প্রবেশ করতে পারলেন না। হুমায়ূনের বাহিনী চলে এসেছে। তিনি পালিয়ে গেলেন।
রানী কর্ণাবতীর মৃত্যু হুমায়ূনকে দুঃখে অভিভূত করল। তিনি তৎক্ষণাৎ বাহাদুর শাহর পেছনে ছুটলেন। রানী কর্ণাবতীর মৃত্যু আরেকজনের মনে গভীর রেখাপাত করল। তিনি বাহাদুর শাহর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান রুমী খাঁ। তিনি তাঁর দলবল নিয়ে হুমায়ূনের সঙ্গে যুক্ত হলেন।
চিতোরের দুর্গ শ্মশান। দুর্গের বাইরে বাহাদুর শাহের অতি প্রিয় দুই হাতি বিকট চিৎকার করছে এবং ছোটাছুটি করছে। হুমায়ূনের হাতে বাহাদুর শাহর প্রিয় দুই হাতি পড়বে তা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না বলে নিজের হাতে এদের শুড় কেটে দিয়েছেন। হাতি দুটির নাম শিরজা ও পতাসিকার। বাহাদুর শাহর প্রসিদ্ধ দুই কামান লায়লা এবং মজনু যেন হুমায়ূনের হাতে না পড়ে সেই ব্যবস্থাও হলো। বাহাদুর শাহ নিজে কামান দুটি নষ্ট করলেন। (* সূত্র: ডক্টর হরিশংকর শ্ৰীবাস্তব, মোঘল সম্রাট হুমায়ূন।)