দূত ভীত গলায় বলল, হুমায়ূন মীর্জার পক্ষে সম্ভব না। তিনি অপারগ।
কেন?
তিনি অচেতন অবস্থায় আছেন। তাঁর জীবনসংশয়।
সম্রাট বাবর রাজসভা ভেঙে দিয়ে ছুটে গেলেন পুত্রকে দেখতে। কোথায় হুমায়ূন মীর্জা? দেখে মনে হচ্ছে একজন মৃত মানুষ পড়ে আছে।
হুমায়ূন মীর্জার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বললেন, উনি চিকিৎসার অতীত। শুধুমাত্র আল্লাহুপাক তার গোপন ভাণ্ডার থেকে যদি কিছু দেন। তবেই হুমায়ূন মীর্জার জীবনরক্ষা হবে।
দিল্লীর চিকিৎসকদের সভা বসল। তাঁরাও বললেন, সম্রাটপুত্ৰ আমাদের চিকিৎসার অতীত। তাঁর জন্যে আল্লাহপাকের কাছে আমরা প্রার্থনা করতে পারি, এর বেশি কিছু করতে পারি না।
সুফি সাধক মীর আবুল কাশিম তখন সম্রাটকে বললেন, পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে আপনি যদি আপনার অতি প্রিয় কিছু দান করেন। তাহলে হয়তো-বা শাহজাদার জীবন রক্ষা হতে পারে।
বাবর বললেন, আমার কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় আর কিছুই নেই। আমি শাহজাদার জন্যে আমার প্রাণ দিতে প্রস্তুত।
হতভম্ব মীর আবুল কাশিম বললেন, সম্রাট আপনি এটা কী বললেন? এই কাজ আপনি করতে পারেন না। আপনি বরং কোহিনূর হীরা দান করে দিন।
বাবর বললেন, আমার পুত্রের জীবনের দাম কি সামান্য একখণ্ড হীরা?
অচেতন হুমায়ূন মীর্জা বিছানায় শুয়ে আছেন। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। ঘরের ভেতরে তিনটা প্ৰদীপ জ্বলছে। সম্রাট বাবর ছাড়া শাহজাদার সঙ্গে আর কেউ নাই। বাবর পুত্রের মাথার পাশ থেকে ঘুরতে শুরু করলেন। তিনি মনে মনে বলছেন, পুত্রের ব্যাধি আমি আমার শরীরে ধারণ করলাম। পরম করুণাময়, তুমি আমার পুত্রকে সুস্থ করে দাও। সম্রাট তিনবার চক্কর দেওয়ার পর পর অচেতন হুমায়ূন চোখ মেলে বললেন, বাবা। আপনি এখানে কী করছেন?
পুত্রের কালান্তক ব্যাধি শরীরে ধারণ করে পঞ্চাশ বছর বয়সে সম্রাটের মৃত্যু হয়। ৬ জমাদিয়াল আউয়াল ৯৩৭ হিজরি, ইংরেজি ২৬ ডিসেম্বর, ১৫৩০। তার তিন দিন পর হুমায়ূন মীর্জা সিংহাসনে বসেন।
নীল রঙের বৈদুৰ্যমণি
সম্রাট হুমায়ূনের বাম হাতে একটি অদ্ভুত সুন্দর হালকা নীল রঙের বৈদুৰ্যমণি (Lapis Lazuli)। ডান হাতে একটি চিঠি। চিঠি পাঠিয়েছেন রাজস্থান থেকে রাজপুত রানী কর্ণাবতী। চিঠির সঙ্গে কয়েকগাছি হলুদ সুতা।
সম্রাট চিঠি পড়ছেন না। চিঠি এবং বৈদুৰ্যমণি এক হাত থেকে আরেক হাতে চালাচালি করছেন। যখন চিঠি ডান হাতে তখন বৈদুৰ্যমণি বাম হাতে। দৃশ্যটি সম্রাটের দুই ভগ্নি গুলবদন এবং গুলচেহরা। চিকের আড়াল থেকে দেখে মজা পাচ্ছে। দরবার চলাকালে এই দুই বোন চিকের আড়াল থেকে দরবারের কাজকর্ম দেখে। সম্রাটের অন্তঃপুরের আত্মীয়স্বজন রাজদরবার দেখার জন্যেই চিকের ব্যবস্থা। যারা দেখবে তারা দরবারের লোকজনের কাছে অদৃশ্য।
প্রধান উজির বললেন, সম্রাট কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত ?
সম্রাট হ্যা-সূচক মাথা নাড়লেন।
চিন্তার বিষয় কি জানতে পারি ?
হ্যাঁ পারেন। জাদুবিদ্যার বইটি এখানো জোগাড় করা গেল না। এই নিয়ে আমি চিন্তিত ।
সম্রাট হিন্দুস্থানের জাদুবিদ্যা নামের একটি বইয়ের সন্ধান পেয়েছেন। বইটি আছে তার ছোটভাই কামরান মীর্জার কাছে। সে সংগ্রহ করেছে কান্দাহারের এক দুর্গ থেকে।
সম্রাট হুমায়ূনের এই বইটি পড়ার খুব ইচ্ছা। বইটি নাকি লেখা হয়েছে প্যাচার রক্ত দিয়ে। দিনের বেলা বইয়ের লেখা অস্পষ্ট থাকে, রাতে স্পষ্ট হয়। সম্রাট তার ভাইয়ের কাছে বইটি চেয়ে পত্র দিয়েছেন। কামরান মীর্জা পত্রের জবাব দেন নি।
উজির বললেন, রানী কর্ণাবতীর পত্রটি কি আপনি পড়বেন? গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।–
সম্রাট চিঠি পড়তে শুরু করলেন
আমি আপনাকে ভাই ডাকলাম। আমাদের নিয়ম অনুযায়ী ভাইকে রাখি পাঠালাম। আমি মহাবিপদে পড়েছি। গুজরাটের বাহাদুর শাহ আমার দুর্গ অবরোধ করেছেন। দুর্গ রক্ষার প্রয়োজনীয় শক্তি আমার নেই। দুর্গে এক হাজার রাজপুত রমণী এবং তিন হাজার শিশু আছে। বাহাদুর শাহ দুর্গে প্রবেশ করলে আমাদের মৃত্যুবরণ করা ছাড়া উপায় নেই।
এখন বোন ভাইকে ডাকছে। ভাই কি বোনকে উদ্ধার করবে?
বোন ভাইয়ের জন্যে একটি বৈদুৰ্যমণি পাঠিয়েছে। কারণ বোন শুনেছে তার ভাই ছবি আঁকেন। বৈদুৰ্যমণি চূর্ণ করে যে নীল রঙ হবে তার দ্যুতি অসাধারণ। বোন কর্ণাবতী আশা করছে তার ভাই এই রঙ ব্যবহার করে একটা ছবি আঁকবে।
ইতি
রানী কর্ণাবতী
সম্রাট চিঠিটি তার প্রধান উজিারের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। প্রধান উজির চিঠি পড়ে বললেন, রত্ন পাঠিয়ে দিন রাজকোষে। চিঠির জবাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ভাই বোনের চিঠির জবাব দেবে না?
রানী কর্ণাবতী বিপদের বোন। বিপদে পড়েছেন বলেই ভাই পাতিয়েছেন। বিপদে না থাকলে এবং তার শক্তি প্ৰবল থাকলে তিনি মোঘল সাম্রাজ্য আক্রমণ করতেও পিছপা হতেন না। তা ছাড়া আপনি নিজেও এখন মহাবিপদে আছেন।
কী রকম?
আপনার ভাই কামরান মীর্জা শক্তি সঞ্চয় করছেন। তিনি পাঞ্জাব দখল করেছেন। তিনি যে-কোনো সময় আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন। একই কথা আপনার আরেক ভাই হিন্দাল মীর্জা সম্পর্কেও সত্যি। এদের চেয়েও অনেক বড় সমস্যা তৈরি করতে যাচ্ছে পাঠান শের খাঁ। সে বাংলা জয় করেছে। আগ্রার দিকে তার যাত্রা শুধু সময়ের ব্যাপার।
হুমায়ূন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত হতে বলুন। আমি স্বয়ং চিতোরের দিকে রওনা হচ্ছি।