আপনার সাহায্য এবং মূল্যবান পরামর্শ ছাড়াই আমি কাবুল দখল করেছি। আগের ভুল এ দফায় করি নাই। দুর্গ দুর্ভেদ্য। হুমায়ূনের অপদাৰ্থ পারস্যসৈনিকরা কিছুই করতে পারবে না।
কাবুল দখল করলে আপনি আমাকে সাহায্য করবেন বলেছিলেন। এখন সাহায্য করুন।
আপনার জন্যে একটি শের পাঠালাম। কাবুল দুর্গ দখলের পরপর এই শেরটি আপনাতেই আমার মাথায় আসে
রাজ্য হলো এমন এক রূপসী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে
সুতীক্ষ্ণ তরবারির প্রয়োজন হয়।
হুমায়ূন। এখন কোথায় আছেন আমি জানি। আপনার সাহায্য পেলেই তাকে শিকল পরিয়ে আপনার সামনে উপস্থিত করব। আপনি তাঁর সঙ্গে রঙ্গ-রসিকতা কিংবা কাব্য আলোচনা করতে পারেন। হুমায়ূন কাব্য আলোচনায় বিশেষ পারদর্শী।
ইতি
মীর্জা কামরান
ইসলাম শাহ্ মীর্যা কামরানের দূতের হাতে পাঁচটি তাম্রমুদ্রা দিয়ে দিলেন।
মীর্জা কামরান দুর্গ রক্ষায় নতুন পরিকল্পনা করেছেন। দুর্গের ভেতর শুধু কামানচিন্দের রাখা হয়েছে। তারা দুর্গপ্রাচীরের চারদিকেই কামান বসিয়েছে।
কামরানের মূল সৈন্যবাহিনী দুর্গের বাইরে গোপনে অবস্থান করছে। বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং মীর্জা কামরান।
বৈরাম খাঁ ঘোড়সোয়ার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন—এই খবর পাওয়া গেছে। বৈরাম খাঁ দুৰ্গ আক্রমণের পর কামান দাগা শুরু হবে। দুর্গের ভেতর থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ হওয়ামাত্র মীর্জা কামরান পেছন থেকে আক্রমণ করবেন। তাঁর মূল লক্ষ্য থাকবে হুমায়ূনকে হত্যা করা। গত কয়েকবারের যুদ্ধে দেখা গেছে, বৈরাম খাঁ’র প্রধান চেষ্টা থাকে হুমায়ূনকে মূল যুদ্ধের বাইরে রাখা। এবারও তাই হবে। হুমায়ূন থাকবেন কামানের গোলার সীমানার বাইরে। পেছন থেকে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়া সহজ হবে।
যুদ্ধ এবং প্রেমে কোনোকিছুই পরিকল্পনামতো হয় না। বৈরাম খাঁ সঙ্গে হুমায়ূনকে আনেন নি। এবং তিনি দুর্গ আক্রমণ করলেন না। কামানের গোলার সীমানার বাইরে অবস্থান নিলেন। নিজের কামানগুলি দুর্গ বরাবর তাক না করে তার সৈন্যদলের পেছনে বসালেন যেন শক্ৰ পেছন থেকে আসতে না পারে। দুৰ্গ লক্ষ্য করে কামান দাগাও যাচ্ছে না। শিশু আকবর সেখানে আছে, গোলার আঘাতে তার ক্ষতি হতে পারে।
মীর্জা কামরান দ্রুত নতুন পরিকল্পনা করলেন। তিনি হুমায়ূন যেখানে আছেন সেখানে চলে যাবেন। বৈরাম খাঁ দুর্গ জয়ে ব্যস্ত থাকবে, তিনি ঝাঁপিয়ে পড়বেন হুমায়ূনের শিবিরে।
বৈরাম খাঁ ফজর ওয়াক্তে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই দুর্গ দখল করলেন। সেদিন ছিল শুক্রবার। মসজিদে হুমায়ূনের নামে খুৎবা পাঠের শেষে শিশু আকবর এবং হামিদা বানুকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন।
রাতের প্রথম প্রহর। তাঁবুর বাইরে হুমায়ূন গালিচা পেতে বসেছেন। আফিম সেবন করবেন, তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। হুমায়ূনের মন খানিকটা বিক্ষিপ্ত। কাবুল জয়ের কোনো খবর এখনো তার কাছে পৌঁছায় নি। এই মুহুর্তে তিনি জোনাকি দেখছেন। এই অঞ্চলের মতো জোনাকি আর কোথাও তিনি দেখেন নি। শত শত জোনাকি দল বেঁধে ঘুরছে। বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে সবাই একসঙ্গে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। তখন মনে হয় কোনো জোনাকি নেই। আবার তারা আলো জ্বালাচ্ছে।
জোনাকি পোকা অনুসরণ করতে গিয়ে নতুন খাটানো ছোট্ট একটা তাঁবুর দিকে হুমায়ূনের চোখ গেল। বিশেষত্বহীন তাঁবু, কিন্তু ছয়জন সৈনিক তাঁবুটি পাহারা দিচ্ছে। তিনি জওহরকে বললেন, তাঁবুটা করি?
জওর বলল, বৈরাম খাঁ’র।
তাঁবুর চারদিকে পাহারা কেন?
জানি না জাহাঁপনা।
অনুসন্ধান করো।
আপনার অনুমতি ছাড়াই আমি অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছিলাম। সৈনিকরা আমাকে তাঁবুর কাছে যেতে দেয় নাই।
হুমায়ূন উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর রহস্য ভেদ করে তিনি আফিন নিয়ে বসবেন। তাঁকে খানিকটা চিন্তিত মনে হলো।
হুমায়ূন বললেন, তাঁবুর ভেতর কী?
সৈনিকরা বলল, তাঁবুর ভেতর একজন কেউ আছে। সে কে আমরা জানি না জাহাঁপনা। বৈরাম খাঁ তাকে তাঁবুতে রেখেছেন। আমাদের ওপর নির্দেশ সে যেন পালিয়ে যেতে না পারে এবং কেউ যেন তাঁবুতে ঢুকতে না পারে। গেলেন। অবিকল তার মতো দেখতে এবং তার সাজ পোশাকে একজন কে তাঁবুর ভেতরে চারপাই-এ বসে আছে। সে সম্রাটকে দেখে উঠে দাঁড়াল এবং কুর্ণিশ করল। হুমায়ূন বলল, তুমি কে?
জাহাঁপনা আমি একজন তুর্ক। আমার নাম হামজা।
তুমি দেখতে অবিকল আমার মতো এটা জানো?
জানি জাহাঁপনা। এই জন্যেই আমাকে আটকে রাখা হয়েছে।
তুমি দেখতে আমার মতো এটা কোনো অপরাধ হতে পারে না। ঘটনা আমাকে খুলে বলো।
জাহাঁপনা, আমি দুসরা হুমায়ূন। যদি কোনো দুৰ্ঘটনায় আপনার প্রাণহানি হয়, তখন আমাকে দেখিয়ে বলা হবে হুমায়ূন জীবিত। সৈন্যদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি যাতে না হয় সেই ব্যবস্থা।
তোমার পেশা কী?
জাহাঁপনা, আমি একজন মুচি। পাদুকা সেলাই করি।
আরেকজন পাদুকা সেলাই করে। কী আশ্চর্য! তুমি আজ রাতে আমার সঙ্গে খানা খাবে।
জাহাঁপনা, এই তাঁবুর বাইরে যাওয়ার আমার হুকুম নাই।
তোমার জন্মতারিখ কী?
আমার মতো মানুষদের জন্মতারিখ কেউ রাখে না জাহাঁপনা।
বিবাহ করেছ?
জি জাহাঁপনা।
স্ত্রীর নাম কী?
যদি গোস্তাকি না নেন। তাহলেই স্ত্রীর নাম বলতে পারি।
গোস্তাকি নেব না।
আমার স্ত্রীর নাম হামিদা।
হুমায়ূন বিড়বিড় করে যে শের আবৃত্তি করলেন তার অর্থ–
বিশ্বের বিপুল রহস্যের আমরা যেটুকু জানি
তাও রহস্যে ঢাকা।।