গোলাপকুঁড়ির মতো আমার হৃদয়
তার দলের উপর রক্তের ছাপ,
লক্ষ বসন্তও আমার সে হৃদয়ের ফুল
কুঁড়ি ফোটাতে পারে না।
গান শুনে সম্রাট অভিভূত হলেন। প্রথমত, গায়িকার অলৌকিক কণ্ঠ। দ্বিতীয়ত, এই গানের চরণগুলি তাঁর লেখা। তাঁর চরণেই সুর বসানো হয়েছে।
সম্রাট বললেন, তোমার নাম?
বাঁদির নাম আসহারি।
গানের চরণগুলি কার রচনা তুমি জানো?
জানি জাহাঁপনা।
সুর কে করেছে?
আপনার সামনে উপস্থিত এই বাঁদি করেছে।
আমার কাছ থেকে উপহার হিসাবে কী চাও?
মাঝে মাঝে আপনাকে গান শোনানোর সুযোগ চাই।
সম্রাটের চোখে পানি এসে গেল। তিনি ঘোষণা করলেন এই গায়িকাকে ওজন করে সমওজনের স্বর্ণমুদ্রা যেন তৎক্ষণাৎ দেওয়া হয়। (*গায়িকাকে ওজন করে সমওজনের স্বর্ণমুদ্রা দেওয়া হয় নি। দেওয়া হয়েছিল তাম্রমুদ্রা। আমীররা সবাই খাজাঞ্জিকে বলেছেন, সম্রাট তাম্রমুদ্রা বলতে গিয়ে নেশার ঝোকে স্বর্ণমুদ্রা বলে ফেলছেন।)
হুমায়ূন মীর্জা বাবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘ পথশ্রমে হুমায়ূন ক্লান্ত, কিন্তু তার চোখ চকচক করছে। মুখমণ্ডল উজ্জ্বল। বাবর বললেন, তুমি কার সামনে দাঁড়িয়ে আছ? সম্রাটের সামনে, না একজন পিতার সামনে?
আমি আমার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
তাহলে তুমি তোমার বাবাকে জড়িয়ে ধরছ না কেন?
হুমায়ূন সম্রাট বাবরকে জড়িয়ে ধরলেন। পুত্রের সঙ্গে পিতার সাক্ষাৎকারের বর্ণনা সম্রাট বাবর তার বিখ্যাত গ্ৰন্থ বাবরনামা-য় এইভাবে দিয়েছেন—হুমায়ূনের উপস্থিতিতে ফুলের মুকুলের মতো আমার হৃদয় ফুটে উঠল। আমাদের চোখ আনন্দে মশালের মতো জ্বলে উঠল।
আমি একটা ভোজের আয়োজন করলাম। আমরা পরম ঘনিষ্ঠভাবে কিছুকাল একসঙ্গে রইলাম। সত্যি বলতে কী, তার আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তার একটা আশ্চর্য মনোজ্ঞ আকর্ষণ ছিল। একজন পূর্ণ মানুষ বলতে যা বোঝায় সে তখন তা-ই ছিল। (Pavet de Courteiile-র অনুবাদ। বাবরনামা-র বিক্ষিপ্ত অংশ।)
নৈশভোজনের পর পিতার সঙ্গে পুত্রের কিছু কথাবার্তা হলো। সম্রাটের খাসকামরায় গোপন বৈঠক। খাসকামরার দরজা-জানালা বন্ধ। ভারী পর্দা নামানো। খাসকামরার বাইরে ছ’জন খোজা প্রহরী। তারা সবাই বধির। যেন গোপন আলোচনার বিষয় তারা শুনতে না পারে। জন্ম থেকে মূক ও বধিরদের প্রহরী পদ দেওয়া হয় না। সুস্থ-সবল খোজা প্রহরীদের কান নষ্ট করে এই পদ দেওয়া হয়।
সম্রাট পুত্রকে কিছু শক্ত কথা বললেন।
বাবর : তুমি বাদাখশান অরক্ষিত রেখে চলে এলে কেন?
হুমায়ূন : এক রাতে হঠাৎ আপনাকে দেখার প্রবল ইচ্ছা হলো। পরদিনই আমি যাত্রা করলাম।
বাবর : তোমার কি ধারণা কাজটা ঠিক হয়েছে?
হুমায়ূন : হ্যাঁ। পুত্রের কাছে পিতা বড়। সাম্রাজ্য বড় না।
বাবর : মনেপ্ৰাণে এই কথা বিশ্বাস করো?
হুমায়ূন : করি।
বাবর : পিতাকে দেখতে চেয়েছিলে দেখা হয়েছে। এখন বাদাখশানে ফিরে যাও। দুর্গ রক্ষা করো।
হুমায়ূন : না।
বাবর : তুমি কি না বলেছ?
হুমায়ূন : বেয়াদবির জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সম্রাট আদেশ করলে আমি এই মুহুর্তেই রওনা হব। কিন্তু আমি আমার পিতার আশপাশে থাকতে চাই। আপনার যদি মনে হয় আমার কর্মকাণ্ডের পেছনে আছে সিংহাসনে বসার লোভ তাহলে ভুল হবে। সিংহাসন আমি bांश् नीं।
বাবর : কোন চাও না?
হুমায়ূন : যুদ্ধ, হত্যা, রাজ্যদখল এইসবে আমার আসক্তি নাই। আমি একা থাকতে পছন্দ করি, আমি পড়াশোনা করতে পছন্দ করি।
বাবর : খবর পেয়েছি। তুমি আফিমের নেশা করছি?
হুমায়ূন : হ্যাঁ।
বাবর : এই ভয়ঙ্কর নেশায় আসক্ত হয়েছ কেন?
হুমায়ূন : আফিম খেলে আমি আশপাশের সবকিছু ভুলে থাকতে পারি।
বাবর : আফিম ছেড়ে দাও। এটা সম্রাটের আদেশ না, পিতার আদেশ। আর যেহেতু তুমি আমার আশপাশে থাকতে চাচ্ছি, আমি তোমাকে সম্বর যেতে বলছি। এখান থেকে কাছে। ইচ্ছা করলেই আমার কাছে চলে আসতে পারবে।
হুমায়ূন : আপনার অনুমতি যেদিন পাব সেদিনই রওনা হব। আপনার কাছে আমার একটা আর্জি আছে।
বাবর : বলো।
হুমায়ূন : কোহিনূর হীরা আমি আপনাকে দিতে চাই। আপনি গ্ৰহণ করলে আমার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হবে। হীরাটা আমার সঙ্গেই আছে।
বাবর : তোমার উপহার আমি গ্ৰহণ করলাম।
হুমায়ূন : আপনাকে নিয়ে এই অক্ষম অভাজন একটি কবিতা লিখেছে।
বাবর : পড়ে শোনাও।
হুমায়ূন : আমার ভগ্নি গুলবদন কবিতাটি আপনাকে পড়ে শোনাবে।
বাবর : তুমি শোনাবে না কেন?
হুমায়ূন : আপনার সামনে লজ্জাবোধ করছি।
বাবর : প্রথম চরণটি বলো।
হুমায়ূন : প্রদীপ্ত সূর্য ছিল আমার পিতার কাছে ম্লান।
হুমায়ূন সম্বর ফিরে গেলেন এবং তাঁর স্বভাবমতো ড়ুব মারলেন। যে বাবাকে দেখার জন্যে এত দূরে ছুটে আসা, সেই বাবার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।
বাবর খবর পেয়েছেন, তার পুত্র বাগানের ভেতর একটা দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকেন। একটা জানালার সামনে তাকে ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে দেখা যায়। প্রচুর পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে ছবি আঁকেন। ছবি আঁকায় একজন হাবশি (খোজা) চিত্রকর তাঁকে সাহায্য করে। (* মোঘল চিত্রকলার শুরু হুমায়ূনকে দিয়ে।)
চার মাস পার হয়ে গেল। এই চার মাসে সম্রাট বাবর পুত্রকে দু’বার আসতে বললেন। হুমায়ূন মীর্জা বেয়াদবির চূড়ান্ত করলেন, চিঠির জবাব দিলেন না।
বাবর সিংহাসনে। দিনের প্রথমার্ধের রাজকাৰ্য শুরু হয়েছে, এই সময় খবর এল পুত্র হুমায়ূন এসেছেন। সম্রাট বললেন, তাকে এক্ষনি এই মুহুর্তে রাজসভায় উপস্থিত হতে বলো।