ইসলাম শাহ্ বললেন, আমার কাছে কী চান?
ধার হিসাবে অর্থ চাই। চড়া সুদ দিতে আমি প্রস্তুত। সৈন্য সংগ্ৰহ করে আমি আবার কাবুল জয় করব। আমি কি অর্থ পেতে পারি?
ইসলাম শাহ বললেন, অবশ্যই অর্থ পেতে পারেন। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ লেগে থাকলে আমার সুবিধা। আপনারা কামড়াকামড়ি করতে থাকবেন, আমি নির্বিয়ে সিংহাসনে বসে থাকব।
মীর্জা কামরান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, কী পরিমাণ অর্থ সাহায্য আমি পেতে পারি?
ইসলাম শাহ্ হাই তুলতে তুলতে বললেন, পাঁচটি তাম্র মুদ্রা দিতে পারি। এতে চলবে?
মীর্জা কামরান হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে আছেন। ইসলাম শাহ্ বললেন, এতক্ষণ আপনি রসিকতা করছিলেন। এখন আমি রসিকতা করলাম।
কামরান বললেন, আপনি আমাকে কোনো সাহায্য করছেন না?
ইসলাম শাহ্ বললেন, আপনি যদি সম্পূর্ণ নিজের অর্থে এবং নিজের সামর্থে আবার কাবুল জয় করতে পারেন তবেই বুঝব আপনি যোগ্য। তখন সাহায্য করব। তার আগে না।
মীর্জা কামরান হনহন করে দরবার ত্যাগ করলেন। দরবারের অমাত্যরা ফিসফিস করে বলতে লাগলেন, ময়ুর! ময়ুর!
কোনো এক বিচিত্র কারণে কামরানের দরবারে ঢোকা এবং বেরুবার সময় তারা ‘ময়ূর, ময়ূর’ করেন।
বৈরাম খাঁ পারস্য সেনাবাহিনীর ওপর যথেষ্ট বিরক্ত। তারা শানশওকত এবং জৌলুস প্রদর্শনে যতটা উৎসাহী যুদ্ধে ততটা না। তাদের হাতের তরবারির ওজন অনেক বেশি। ওজনের কারণে তরবারি চালানোর ক্ষিপ্ৰতা তাদের নেই। কম ওজনের তরবারি দেওয়া হয়েছিল। ফলাফল আরও খারাপ। অনভ্যস্ততার কারণে হালকা তলোয়ার এরা চালাতেই পারে না।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হস্তীবাহিনীর ভয়ে তারা ভীত। হিন্দুস্থানের যুদ্ধে হস্তীবাহিনী থাকবেই—এই সত্যটা পারস্যবাহিনীর মাথায় এখনো ঢোকে নি।
হুমায়ূন জানিয়েছেন, পারস্যবাহিনীর এখন আর তাঁর প্রয়োজন নেই। তারা যেন পারস্যে চলে যায়।
পারস্যবাহিনীর প্রধান বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছেন, তারা পারস্য ফিরে যেতে আগ্রহী না। বাকি জীবন তারা হুমায়ূনের সেবা করবে। তারা ফিরে যেতে চাচ্ছে না কেন তাও পরিষ্কার না।
হুমায়ূনের রাজকীয় কাফেলা এখন আছে ‘পাঞ্জশীরে’। জায়গাটা অতীব মনোরম। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা। ফলের বাগান। সবুজ মাঠ। ছোট ছোট টিলা। বনের ভেতর দিয়ে পাহাড়ি যে নদী গিয়েছে, তার জল কাকের চোখের মতো স্বচ্ছ। হুমায়ূনকে বেশির ভাগ সময় দেখা যায়। নদীর উপরের বড় পাথরের চাইয়ে বসে আছেন। হাতে মীর্জা কামরানের লাইব্রেরির কোনো একটা বই। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর বই পড়তেই এখন তিনি আগ্রহী। পারস্যে তিনি মানমন্দির দেখে এসেছেন। রাজ্য ফিরে পেলে পারস্যের মতো একটি মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করা তার গোপন বাসনা। আকাশে শুক্র গ্রহ দেখা গেলে ফজরের নামাজের সময় হয়। যখন গ্রহটি আর দেখা যায় না, তখন ফজরের নামাজের সময় শেষ। এই তথ্য তিনি পারস্য মানমন্দির থেকে জেনে এসেছেন। বিষয়টি এখনো পরীক্ষা করা হয় নি।
হুমায়ূন পাঠে মগ্ন। তার দুটি পা পানি স্পর্শ করে আছে। পানি শীতল। মাঝে মাঝেই তাকে পা পানি থেকে তুলতে হচ্ছে। হুমায়ূনের আনন্দময় সময়ে জওহর আবতাবচি দুঃসংবাদ নিয়ে উপস্থিত হলো।
মীর্জা কামরান আবার কাবুল দখল করেছেন এবং নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছেন।
হুমায়ূন বই বন্ধ করতে করতে বললেন, আফসোস। বৈরাম খাঁকে ডেকে নিয়ে আসো।
জওহর ছুটে যেতে গিয়ে পাথরে ধাক্কা খেয়ে পানিতে পড়ে গেল। হুমায়ূন তাকে টেনে তুলতে তুলতে বললেন, কোরান শরিফের একটি আয়াতে বলা হয়েছে হে মানব সম্প্রদায়! তোমাদের বড়ই তাড়াহুড়া। জওহর-তাড়াহুড়ার কিছু নেই। যা নিয়তিতে নির্ধারিত তা-ই হবে। তাড়াহুড়া করে কিছু হবে না।
পাশাপাশি দুটা পাথর। একটিতে হুমায়ূন বসেছেন, অন্যটিতে বৈরাম খাঁ। বৈরাম খাঁকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখাচ্ছে। এত চিন্তিত তাকে সচরাচর দেখা যায় না। চিন্তার প্রধান কারণ হামিদা বানু এবং তাঁর শিশুপুত্ৰ আকবর কামরানের হাতে আটক হয়েছেন। এই খবর হুমায়ূন জানেন না। হামিদা বানু এবং আকবর ছিলেন কান্দাহার দুর্গে। কান্দাহার থেকে তারা কেন কাবুলে গেলেন, কখন গেলেন তা বৈরাম খাঁ জানেন না।
হুমায়ূন বললেন, আপনি এত চিন্তিত হবেন না। আমার ভাই আকবরের কোনো ক্ষতি করবে না। এটা তৈমুর বংশের ধারা।
জাহাঁপনা, বংশের ধারা সবসময় কাজ করে না।
আমার ভাইদের ক্ষেত্রে করবে।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি এই মুহুর্তেই রওনা হব। আপনি এখানেই থাকবেন। জায়গাটা আপনার পছন্দ হয়েছে। আপনি বিশ্রাম করুন। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশকে রেখে যাচ্ছি। আপনার নিরাপত্তার জন্যে আপনি নিজেই যথেষ্ট। তারপরেও মীর্জা হিন্দাল থাকবেন।
হুমায়ূন বললেন, বৈরাম খাঁ, আমি আপনার সঙ্গে যাব। এখন পর্যন্ত এমন কোনো যুদ্ধ হয় নি যেখানে আমি যুদ্ধ পরিচালনা করি নি।
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনি এখানেই থাকবেন। ভবিষ্যতে অনেক যুদ্ধ হবে। কোনোটাতেই আপনাকে অংশগ্রহণ করতে হবে না। যা করতে আপনার পছন্দ। আপনি তা-ই করবেন। বই পড়বেন, ছবি আঁকবেন, গান শুনবেন। এখন আপনার অনুমতি পেলে আমি যুদ্ধযাত্রা করি?
সম্রাট হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
মীর্জা কামরানের বিশেষ দূত এসেছে ইসলাম শাহ’র কাছে। দূতের কাছে পত্রে কামরান লিখেছেন–
হাস্য পরিহাসে পটু
দিল্লীর সিংহাসনের মালিক
ইসলাম শাহ্
জনাব,