তিন বছর পর আকবর তার বাবা-মাকে সামনে দেখল। সে হুমায়ূনের দিকে আঙুল তুলে বলল, তুমি কে?
হুমায়ূন বললেন, আমি কেউ না। আমি শুধু তোমার বাবা।
শিশু আকবর বলল, আমার বাবা দিল্লীর সম্রাট বাদশাহ হুমায়ূন। তুমি না।
হুমায়ূনের নির্দেশে হামিদা বানু এসে শিশুপুত্রকে কোলে তুললেন।
আকবর বলল, তুমি কে?
হামিদা বানু বললেন, আমি তোমার মা। যখন চারদিকে কামানের গোলা পড়ছিল তখন তুমি কি ভয় পাচ্ছিলে?
হ্যাঁ।
তোমাকে আর ভয় পেতে হবে না। তোমার বাবা চলে এসেছেন।
হামিদা বানু স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, একটি ফরমান জারি করুন। লাইব্রেরির বই যেমন আপনার চোখের আড়াল হবে না, আপনার পুত্রও আপনার চোখের আড়াল হবে না।
দলে দলে সৈন্য হুমায়ূনের পক্ষে যোগ দিচ্ছে। এদের বেতন দেওয়ার সামৰ্থ্য হুমায়ূনের নেই। সৈন্যরা বলল, এখন আমাদের কোনো বেতন দিতে হবে না। আপনি দিল্লীর সিংহাসনে বসার পর বেতন দেবেন।
কামরান পালিয়ে লাহোর দুর্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বৈরাম খাঁ দুৰ্গ দখল করলেন। কামরান মেয়েদের পোশাক পরে দুর্গ থেকে পালালেন। তাকে চেনার কোনো উপায় নেই। তিনি চুল-দাড়ি কামিয়ে সর্বহারা সন্ন্যাসীর ভেক ধরেছেন। তিনি রওনা হয়েছেন দিল্লীর দিকে। দিল্লীর সম্রাট ইসলাম শাহ’র কাছ থেকে যদি কোনো সাহায্য পাওয়া যায়।
কাশির রাজপথে আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা এক তরুণী হেঁটে যাচ্ছে। তরুণী হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। রাস্তার পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধের সামনে এসে দাঁড়াল। তরুণী বলল, আমি আপনাকে চিনি। আপনার নাম আমার মনে নেই, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।
বৃদ্ধ বলল, আমি আপনাকে চিনি না। আপনাকে চিনতেও চাচ্ছি না।
তরুণী বলল, হুমায়ূন-কন্যা আকিকা বেগম এবং তার বান্ধবী অম্বাকে কি আপনি চেনেন?
আমি কাউকে চিনি না।
এই দুজনকে আপনি আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন।
বৃদ্ধ বলল, তুমি উন্মদিনী। উন্মদিনীর সঙ্গে আমি কথা বলি না।
তরুণী আমাদের পরিচিত। তার নাম আসহারি। সম্রাট হুমায়ূন তাকে ‘আগ্রার বুলবুলি’ উপাধি দিয়েছিলেন। চৌসার যুদ্ধে সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সাঁতরে তীরে উঠেছে। সম্রাট-কন্যার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটনার সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আসহারি অপেক্ষায় আছে কোনো একদিন সম্রাট হুমায়ূনকে ঘটনাটি জানাবে।
শের শাহ কাজীর দুর্গ
শের শাহ কাজীর দুর্গ পরিদর্শনে গিয়েছেন। দুর্গপ্রাচীরের কামানগুলির অবস্থা কী দেখছেন। হঠাৎ একটি গোলাভরা কামান বিস্ফোরিত হলো। শের শাহ্ লুটিয়ে পড়লেন। মৃত্যুর আগে কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর জ্ঞান ফিরল। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আমি মারা যাচ্ছি। দিল্লীর সিংহাসন আমি প্রথম পুত্ৰ জালাল খাঁ’র জন্যে নির্ধারণ করেছি। পুত্ৰ জালাল খাঁ সিংহের মতো সাহসী। একমাত্র সে-ই পারবে মোঘলদের হাত থেকে সিংহাসন রক্ষা করতে। আমার মন বলছে হুমায়ূন হারানো সিংহাসন পেতে ফিরে আসবেন।
জালাল খাঁ ইসলাম শাহ নাম নিয়ে দিল্লীর সিংহাসনে বসলেন।
ইসলাম শাহ্ কাব্যানুরাগী মানুষ ছিলেন। নিজে শের লিখতে পারতেন না, যারা পারত। তাদের প্রতি তার ভালোবাসার সীমা ছিল না। মানুষ হিসেবে তার অন্য গুণাবলিও ছিল। মদ্যপান বা কোনো নেশাজাতীয় বস্তুর প্রতি তাঁর কোনো আকর্ষণ ছিল না।
শের শাহ সম্পূর্ণ হিন্দুস্থানের রাস্তাঘাট বানানোর যে কাজ শুরু করেছিলেন, ইসলাম শাহ সেই কাজ শেষ করতে চেয়েছিলেন।
দিল্লীর মানুষজন ইসলাম শাহকে পছন্দ করত।
মুণ্ডিত মস্তক শ্মশ্রুবিহীন মীর্জা কামরান দিল্লীর সম্রাট ইসলাম শাহ’র সামনে বসে আছেন। কামরানকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ইসলাম শাহ রসিকতা করে বললেন, আপনাদের মহিলারাও কি আপনার মতো মাথার চুল কামিয়ে ফেলে?
কামরান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না। তারা আপনাদের মতো বিশাল গোফ রাখে।
ইসলাম শাহহাসতে হাসতে বললেন, আপনার রসবোধ দেখে মুগ্ধ হলাম। আপনি চমৎকার শের লেখেন জানতাম। রসিকতা করতে পারেন জানতাম না। আপনার একটি শের শোনান।
কামরান আবৃত্তি করলেন—
গর্দিশে গরদূনে গরদ না রা দর্গ কর্দ
বর সরে আহলে তমৗজা ওয়া নাকি সারা মর্দ কর্দ
(ললাটের এমনই লিখন যে সে শ্রেষ্ঠ জনকে মাটিতে মেশায়, যোগ্যদের মাথার উপর অযোগ্যদের বসায়)
ইসলাম শাহ্ গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি কি আমার প্রতি ইঙ্গিত করছেন?
কামরান বললেন, না। রসিকতা করলাম। একটু আগে আপনি আমার রসবোধের প্রশংসা করেছেন বলেই শেরের মাধ্যমে রসিকতা। আপনি নিজে খুব ভালো করে জানেন যোগ্যরাই থাকে। অযোগ্যরা ধুলায় মিশে যায়।
ইসলাম শাহ বললেন, আপনি নিজেকে কী ভাবেন? যোগ্য না অযোগ্য?
কামরান বললেন, সময় ঠিক করে দেবে আমি যোগ্য না অযোগ্য। তবে হুমায়ূন অযোগ্য তাতে সন্দেহ নাই।
ইসলাম শাহ্ বললেন, কান্দাহার যুদ্ধে আপনি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন।
আমি বিভ্রান্ত ছিলাম। পারস্য-সম্রাট হুমায়ূনকে আমার হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পারস্যবাহিনীকে দেখে আমি ভেবেছি তারা হুমায়ূনকে বন্দি করে নিয়ে আসছে।
কাবুলের যুদ্ধেও আপনি পরাজিত হয়েছেন।
এখানে আমার হিসাবে কিছু ভুল হয়ে গিয়েছিল। অতীতে দেখেছি যে-কোনো যুদ্ধে জয় লাভের পর হুমায়ূন পানাহারের উৎসব বসান। দিনের পর দিন উৎসব চলতে থাকে। আমি কল্পনাও করি নাই হুমায়ূন তৎক্ষণাৎ কাবুলের দিকে যাত্রা করবেন। আমি দুর্গ গোছানোর সময় পাই নাই।