জ্যোতির্বিদ্যার।
মক্কায় জ্যোতির্বিদ্যার পাণ্ডুলিপি নিয়ে আপনি কী করবেন?
হুমায়ূন জবাব দিলেন না।
লক্ষ্যভেদ খেলায় হুমায়ূন ভালো করলেন। পাঁচটি তীরের মধ্যে তিনটি লক্ষ্য ভেদ করল। শাহ্ বললেন, আপনার মনোসংযোগ প্রক্রিয়া এখনো ঠিক আছে, এটা ভালো। আপনার অবস্থায় আমি পারতাম না। মাছ শিকারে কি আপনার আগ্রহ আছে?
না।
শাহ বললেন, অনাগ্রহের বিষয়ও আমাদের মাঝে মাঝে করতে হয়।
তা হয়।
সন্ন্যাস ব্ৰত নিয়ে মক্কা শরিফে যেতে ইচ্ছা করে না। কিন্তু যেতে হয়। ঠিক বলছি না?
হ্যাঁ ঠিক বলেছেন।
শাহ বললেন, এবার আপনাকে একটি জটিল প্রশ্ন করছি। শুনেছি জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনি বিশেষ পারঙ্গম। প্রশ্নটি হলো, আল্লাহ কোথায় বাস করেন?
হুমায়ূন সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তিনি বাস করেন ব্যথিত মানুষের অন্তরে।
আপনি ব্যথিত মানুষ। তিনি কি আপনার অন্তরে বাস করছেন?
হুমায়ূন জবাব দিলেন না।
শাহ বললেন, আমরা ভোরবেলা মাছ শিকারে যাব। শিকারপদ্ধতি আমি শিখিয়ে দেব। জটিল কিছু না। বঁড়িশিতে মাছ গেঁথে তাকে খেলাতে হয়। যে যত ভালো খেলাতে পারে সে তত বড় শিকারি।
মাছধরা খেলা খুবই জমেছে। শাহ প্ৰকাণ্ড একটা মাছ ধরেছেন। আনন্দউত্তেজনায় তিনি ঝলমল করছেন। হুমায়ূন বললেন, মাছ শিকার একটি মনোমুগ্ধকর খেলা। দেখে আমি আনন্দ পেয়েছি। শিকারির আহত হওয়ার ভয় নেই, কিন্তু শিকারের আনন্দ পুরো মাত্রায় আছে। আমি আরেক বার এই শিকারে আসতে চাই। নিজের হাতে একটা মাছ ধরতে চাই।
শাহ তামাস্প বললেন, সেই সুযোগ আপনি পাবেন না। আপনার ভাই মীর্জা কামরানের হাতে আপনাকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় তুলে দিতে হবে। বিনিময়ে আমি পাব কান্দাহার।
হুমায়ূন চুপ করে রইলেন।
তামাস্প নির্বিকার গলায় বললেন, আপনাকে জীবিত অবস্থায় তাঁর হাতে তুলে দেওয়াটাই পারস্য-সম্রাটের জন্যে সম্মানজনক। আপনাকে হত্যা করলে লোকে বলবে আমার কাছে আশ্রয়প্রাপ্ত এক রাজ্যহারা সম্রাটকে আমি হত্যা করেছি।
হামিদা বানুর সঙ্গে কি একবার দেখা করতে পারব?
অবশ্যই। হামিদা বানু ও জীবিত অবস্থায় আপনার সঙ্গে যাবেন। আপনার প্ৰিয় বৈরাম খাঁও যাবে।
হুমায়ূন বললেন, আপনি আমার একটি অনুরোধ রাখুন। আমাকে একা কামরানের হাতে তুলে দিন। আমার স্ত্রী এবং বৈরাম খাঁকে মক্কা যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন।
শাহ তামাস্প বললেন, তা হয় না।
হুয়ায়ূনকে শাহ সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে নিয়ে এলেন। পারস্য-সম্রাটের বিশাল বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত অবস্থায় আছে।
শাহ বললেন, এই বাহিনীতে কুড়ি হাজার অত্যন্ত দক্ষ ঘোড়সওয়ার আছে। আপনি এদের সঙ্গে নিয়ে জীবিত অবস্থাতেই কান্দাহার যাবেন। কান্দাহার দখল করে আমাকে দেবেন। আমার কথা ঠিক রইল, আপনি জীবিত অবস্থায় কান্দাহার গেলেন। আমি কান্দাহার পেলাম। আপনার সঙ্গে আমার পুত্র মুরাদ যাবে। তাকে কান্দাহারের সিংহাসনে বসানোর দায়িত্ব আপনার। মোঘল সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারে আপনি আমার বাহিনী ব্যবহার করতে পারেন।
হতভম্ভ হুমায়ূন তাকিয়ে আছেন। পুরো বিষয়টা বুঝতে তাঁর সময় লাগছে।
শাহ্ তামাস্প হাত বাড়িয়ে বললেন, বন্ধু বিদায়।
হুমায়ূন শাহকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর চোখ অশ্রুসিক্ত।
শাহ তামাস্প বললেন, আপনার হৃদয় কি এখনো ব্যথিত?
হুমায়ূন বললেন, না। শাহ তামাস্প হাসতে হাসতে বললেন, এটা তো দুঃসংবাদ। এখন তাহলে আল্লাহ্ আপনার হৃদয়ে অনুপস্থিত। হা হা হা।
প্রধান সেনাপতি বৈরাম খাঁ’র নেতৃত্বে পারস্য বাহিনী কান্দাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি বিশেষ শকটে যাচ্ছেন হামিদা বানু। তার কোলে পারস্য-সম্রাটের শিশুপুত্র মুরাদ, যে কান্দাহারের সিংহাসনে বসবে। শিশুপুত্রের বয়স মাত্র তিন মাস। শিশুপুত্রকে দুধ খাওয়ানোর জন্যে তিনজন দুধ-মাও যাচ্ছেন।
কান্দাহার দখল হলো বিনা যুদ্ধে। কামরানের সৈন্যদের বড় অংশ হুমায়ূনের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হলো। কামরান পালিয়ে কাবুল দুর্গে আশ্রয় নিলেন। মীর্জা হিন্দালকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে সেনাবাহিনীর একাংশের দায়িত্ব দেওয়া হলো।
কান্দাহার দুর্গের পতনের ফলে মীর্জা কামরানের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি হুমায়ূনের দখলে চলে এসেছে। লাইব্রেরিতে পাণ্ডুলিপির বিপুল সংগ্ৰহ দেখে হুমায়ূন মুগ্ধ। হুমায়ূন নির্দেশ জারি করলেন, এখন থেকে তিনি যেখানে যাবেন লাইব্রেরির প্রতিটি গ্রন্থ তাঁর সঙ্গে যাবে।
শিশু মুরাদকে সিংহাসনে বসিয়ে হুমায়ূন ছুটলেন কাবুলের দিকে। কাবুল দুর্গ ঘেরাও করা হলো। হুমায়ূন কামান দাগার নির্দেশ দিলেন। দুৰ্গকে কামানের আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য মীর্জা কামরান বিচিত্র কৌশল অবলম্বন করলেন। তিন বছর বয়সী আকবরকে উঁচু খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দুর্গচূড়ায় খুঁটি লাগিয়ে দেওয়া হলো। কামানের গোলা ভেতরে পড়লেই শিশু আকবর নিহত হবে। হুমায়ূনের নির্দেশে গোলাবর্ষণ বন্ধ হলো।
বৈরাম খাঁ হুমায়ূনকে বললেন, আপনি নিশ্চিত মনে তাঁবুতে অপেক্ষা করুন। আমার সঙ্গে অতি দক্ষ দুজন কামানচি আছে। এরা এমনভাবে কামান দাগবে যে, আপনার শিশুপুত্রের কোনো ক্ষতি হবে না। দ্রুত আমরা দুর্গের দখল নেব।
হুমায়ূন তাঁবুর ভেতর ঢুকে অজু করে নামাজে বসলেন। কামানের গর্জনে তাঁবু কেঁপে কেঁপে উঠছে। হুমায়ূন নামাজে মন দিতে পারছেন না। নামাজের মাঝখানেই জওহর আবিতাবচি উত্তেজিত গলায় খবর দিল-জাহাঁপনা আমরা কাবুল দুর্গ দখল করেছি। বৈরাম খাঁ দুর্গে ঢুকে পড়েছেন। যুবরাজ আকবর সুস্থ আছেন। মীর্জা আসকারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।