দুপুরে মীর্জা কামরান একটি দুঃসংবাদ পেলেন। কান্দাহার থেকে মীর্জা হিন্দাল পালিয়েছেন। তিনি হুমায়ূনের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্যে পারস্যের দিকে যাত্রা করেছেন।
মীর্জা কামরান ফরমান জারি করলেন, যে হিন্দালকে জীবিত বা মৃত তার কাছে নিয়ে আসতে পারবে তাকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দেওয়া হবে।
মীর্জা হিন্দাল যে দুজনের সাহায্যে পালিয়েছিলেন তারাই তাঁকে ধরে এনে সন্ধ্যার মধ্যে মীর্জা কামরানের কাছে হাজির করল। তারা এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কারের দাবিদার।
মীর্জা কামরান দুজনের প্রত্যেককেই পাঁচ শ স্বর্ণমুদ্রা দিতে খাজাঞ্চিকে হুকুম দিলেন। পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ তারা করেছে, তবে একজন শাহজাদার বিশ্বাসভঙ্গ করার মতো অপরাধও তারা করেছে। এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে দুজনের স্বর্ণমুদ্ৰাই বাজেয়াপ্ত হবে। একই সঙ্গে তিনি দুজনকেই অন্ধ করার নির্দেশ দিলেন।
হিন্দালকে পাঠানো হলো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীদের যেখানে রাখা হয়। সেখানে। মীর্জা কামরান হিন্দালকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে হাতির পায়ের নিচে হিন্দালের মাথা চূৰ্ণ করে।
মীর্জা কামরান নির্দেশ দিলেন কাবুল থেকে জল্লাদ হাতি ছোট কুমারকে আনতে। মীর্জা কামরান তওবা করে হিন্দালকে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হতে বললেন।
জল্লাদ-হাতি চলে এসেছে
জল্লাদ-হাতি চলে এসেছে। বেলা দ্বিপ্রহর। শাস্তিপ্রদান অনুষ্ঠান দেখার জন্যে উৎসুক কিছু মানুষজন দেখা যাচ্ছে। তাদের চোখে কৌতূহল এবং শঙ্কা।
হিন্দালকে হাতে-পায়ে শিকল বাধা অবস্থায় বিশাল প্রস্তরখণ্ডের কাছে নেওয়া হয়েছে। হিন্দাল প্রস্তরখণ্ডের ওপর মাথা রেখে নিশ্চল হয়ে থাকবেন। হাতি বা পা তাঁর মাথার উপর রাখবে। মৃত্যুদণ্ডে হাতির বী পা ব্যবহার করা হয়।
মীর্জা কামরান হাতে লাল রুমাল নিয়ে বসে আছেন। রুমাল ফেলে দিলেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে।
মাওলানা শেষবারের মতো হিন্দালকে তওবা পড়ালেন। কোরানপাকের একটি আয়াত আবৃত্তি করলেন, যার অর্থ–
আজ তুমি যেখানে যাচ্ছ একদিন আমরাও সেখানে যাব।
কামরান রুমাল ফেলে দিয়েছেন। হাতি তার বা পা হিন্দালের মাথা স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু মাথা গুড়িয়ে দিচ্ছে না।
মীর্জা কামরান বললেন, সমস্যা কী?
হাতির মাহুত বলল, জাহাঁপনা বুঝতে পারছি না।
কামরান তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যারা হত্যাকাণ্ড দেখতে এসেছে, তাদের মধ্যে ফিসফিস কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এমন ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি।
হাতি ডানে বাঁয়ে খুব দুলছে। শুড় নাচাচ্ছে। কিন্তু মূল কাজটা করছে না। মীর্জা কামরান বললেন, বন্দিকে নিয়ে যাও।
হাতির পায়ের নিচ থেকে মুক্ত হওয়া মানুষের মৃত্যুদণ্ড বাতিল হয়ে যায়। এটাই নিয়ম। জনতা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিল। এর অর্থ আল্লাহ শ্রেষ্ঠ। কামরান বুঝতে পারছেন না। এই ধ্বনি কি তারা হিন্দালের পক্ষে দিল? এত সাহস তাদের হওয়ার কথা না।
মীর্জা কামরান তার খাস কামরায়। হাতির মাহুত তাঁর সামনে। ভয়ে সে অস্থির হয়ে আছে। কামরান কঠিন গলায় বললেন, তোমার নাম কী?
বাহাদুর।
তুমি মাহুতের কাজ কত বছর ধরে করছ?
আপনার পিতা জীবিত থাকা অবস্থাতেও আমি মাহুত ছিলাম।
হাতি পা নামায় নি কেন?
বাহাদুর বলল, এর উত্তর আল্লাহপাক জানে এবং হাতি জানে। আমি জানি না।
মীর্জা কামরান বললেন, অবশ্যই তুমি জানো। হাতি পা ফেলবে। তোমার ইশারায়। সেই ইশারা তুমি দাও নাই।
মাহুত চুপ করে রইল।
নির্দেশ না দেওয়ার জন্যে তুমি কি কারও কাছ থেকে উৎকোচ নিয়েছ?
না।
হিন্দালের জীবন কেন বাঁচাতে চেয়েছ? সত্যি জবাব দাও। সত্যি জবাব দিলে তোমাকে প্ৰাণ ভিক্ষা দেব। মিথ্যা জবাব দিলে তোমাকে হাতির পায়ের নিচে মরতে হবে।
বাহাদুর বলল, মীর্জা হিন্দালকে সম্রাট হুমায়ূন অত্যন্ত পছন্দ করেন। ভাইয়ের করুণ মৃত্যুর খবর পেলে সম্রাট কষ্ট পাবেন ভেবেই হাতিকে নির্দেশ দিই নাই।
সত্যি কথা বলায় আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু সত্যটা শুনে অবাক হয়েছি। তুমি বিশ্বাসঘাতক। বিশ্বাসঘাতকের একটাই শাস্তি—মৃত্যুদণ্ড।
কামরানের নির্দেশে বাহাদুরের মাথা হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করা হলো। জল্লাদ হাতিই কাজটা করল, তবে এবার মাহুত ভিন্ন।
হিন্দালের হাতির পায়ের নিচে থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনায় কামরান বিচলিত, তবে সেই দিনই আনন্দিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। পারস্য-সম্রাট দূত মারফত তাঁর চিঠির জবাব পাঠালেন। সেখানে লেখা—যথাসময়ে আপনার ভাই হুমায়ূনকে জীবিত অবস্থায় আপনার কাছে পাঠানো হবে। কান্দাহার সিংহাসনে বসবে আমার পুত্ৰ মুরাদ।
হুমায়ূনের ধারণা তাকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। বৈরাম খাঁ’র সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগ নেই। আমীররা থাকছেন আলাদা। তিনি হামিদা বানুর কাছ থেকেও বিচ্ছিন্ন। তাঁকে বলা হয়েছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একজন শিয়া একজন সুন্নি। পারস্য সাম্রাজ্যে তারা একত্রে থাকতে পারবেন না।
বৈরাম খাঁ’র বিষয়ে হুমায়ূন নিজেই শাহকে জিজ্ঞেস করলেন।
শাহ বললেন, বৈরাম খাঁকে আপনার প্রয়োজন কেন? সে আপনার অধীনস্থ। একজন কর্মচারী মাত্র। তার সঙ্গে সময় কাটানোর কিছু নেই। নিঃসঙ্গ বোধ করলে আমাকে ডাকবেন। দুজনে গল্প করব। চলুন আজ লক্ষ্যভেদ খেলা খেলি।
চলুন।
শুনেছি। রাজকীয় লাইব্রেরিতে আপনি প্রচুর সময় কাটান। কিছুদিন হলো গভীর মনোযোগে আপনি একটি পাণ্ডুলিপি কপি করছেন। কিসের পাণ্ডুলিপি?