বৈরাম খাঁ বলল, এই সৌভাগ্য আমার হয় নি।
তামাস্প হাত ইশারায় বৈরাম খাঁকে চলে যেতে বলে পানিপাত্রে মনোযোগ দিলেন। তাকে অত্যন্ত বিরক্ত দেখাচ্ছে।
ভোজসভায় পারস্য সাম্রাজ্যের শানশওকত দেখানোর সব চেষ্টাই শাহ তামাস্প করেছেন।
বিশাল তাঁবুতে ভোজসভা বসেছে। চারদিক আলো ঝলমল করছে। নর্তকী এবং বাদ্যযন্ত্রীরা প্ৰস্তুত। সম্রাটের ইশারা পেলেই গানবাজনা শুরু হবে।
রান্না হচ্ছে দুটি আলাদা রন্ধনশালায়। একটিতে পারস্যের রান্না। অন্য রন্ধনশালায় হিন্দুস্থানি বাবুর্চি তৈরি করছে খোসাকা পোলাও।
শাহ তামাস্প এবং হুমায়ূন মুখোমুখি বসেছেন। তামাস্পের সঙ্গে তাঁর আমীর এবং সেনাপতিরা। হুমায়ূনের সঙ্গে তার চারজন আমীর এবং বৈরাম খাঁ। হুমায়ূন শাহের পাঠানো শিয়া টুপি পরেন নি। শাহ তাতে খুব অসন্তুষ্ট এমন মনে হচ্ছে না, বরং তাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছে। শাহের নির্দেশে হুমায়ূনের সামনে একটি সোনার থালা রাখা হলো। থালায় মহামূল্যবান মণিরত্ন।
শাহ বললেন, পারস্যের পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। ভোজসভায় উপহার বিনিময়ের রেয়াজ আছে। তবে আপনার অবস্থা আমরা অনুমান করতে পারছি। আপনার কাছ থেকে উপহার হিসেবে শুভেচ্ছা পেলেই আমরা সন্তুষ্ট। শাহের উপস্থিত আমীররা এ কথায় হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। কারও কারও ঠোঁটে বিন্দ্ররূপের হাসি দেখা গেল।
হুমায়ূন বললেন, মহামান্য শাহ তামাস্পের জন্যে আমার পক্ষ থেকে সামান্য উপহার। এই উপহার গ্রহণ করলে আমি এবং আমার সঙ্গীরা আনন্দিত হব।
হুমায়ূন সবুজ রেশমি রুমালে ঢাকা একটি পাথর এগিয়ে দিলেন।
শাহ তামাস্প রুমাল খুলে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক মুহুর্ত তাঁর মুখে কোনো কথা ফুটল না। শাহের আমীররা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে নিচুস্বরে ফিসফিস শুরু হলো।
তামাস্প বললেন, এইটিই কি সেই বিখ্যাত কোহিনূর?
বৈরাম খাঁ বললেন, আলমপনা, এইটি সেই কোহিনূর যা তরবারি দিয়ে পেতে হয় অথবা ভালোবাসার উপহার হিসেবে পেতে হয়।
কোহিনূরের উপর আলো পড়েছে। মনে হচ্ছে সবুজ রেশমি রুমালের মাঝখানে আগুন ধরে গেছে।
শাহ তামাস্পের নির্দেশে খাবার পরিবেশন শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে নৃত্যগীতের আসর বসেছে। সাতজন নর্তকী নাচছে। তাদের সঙ্গে বাদ্যবাজনা। বাদ্যবাজনার সুর করুণ কিন্তু নাচের ভঙ্গি উচ্ছল। দুই বিপরীত ধারা চমৎকার মিল খেয়ে গেছে।
হুমায়ূন মুগ্ধ হয়ে নাচ দেখছেন। শাহ তামাস্প বললেন, এইসব নর্তকীকে আমি উপহার হিসেবে আপনাকে দিলাম। আপনার তাঁবুর পাশেই এদের তাঁবু। আপনি ইচ্ছা করলেই নর্তকীদের ব্যবহার করতে পারেন। তবে মক্কায় গেলে এদের নিয়ে যেতে পারবেন না। হা হা হা।
শাহ নিজের রসিকতায় হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছেন। আমীররাও হাসছেন। সুরা তার প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে।
নিশিরাত পর্যন্ত পান ভোজন চলল। শাহ তামাস্প পরদিন তার সঙ্গে বাঘ শিকারে যাওয়ার জন্যে হুমায়ূনকে আমন্ত্রণ জানালেন। ভোজসভায় শিয়া প্রসঙ্গ উঠল না।
মীর্জা কামরান ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন। তাঁর শরীর ঘামে ভেজা। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। দুঃস্বপ্নে তিনি দেখলেন, তাকে ঢোকানো হয়েছে গাধার চামড়ায়। চামড়া সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। একটা খোলা ঘোড়ার গাড়ির পাটাতনে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ঘোড়ার গাড়ির চালক রুপার ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে বলছে, মহান মোঘল সম্রাট হুমায়ূনের নির্দেশে মীর্জা কামরানকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। ঘোড়ার গাড়ির পেছনে শত শত শিশু। তাদের খিলখিল হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মীর্জা কামরান সুরাইভর্তি পানি খেলেন। তাতেও তাঁর তৃষ্ণা মিটাল না। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠি লিখতে বসলেন। এই চিঠি যাবে পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্প’র কাছে।
মীর্জা কামরানের পত্ৰ
মহান পারস্য-সম্রাট
পৃথিবীর সূর্য, জগতের সৌন্দর্য, সর্বশক্তির আধার
শাহ তামাস্প,
আমার বড়ভাই, মোঘল সাম্রাজ্যের কলঙ্ক হুমায়ূন বিষয়ক কিছু কথা।
জাহাঁপনা, আমার এই ভীরু কাপুরুষ বিচার বুদ্ধিহীন ভ্রাতার কারণে আমরা দিল্লীর সিংহাসন হারিয়েছি। হাজার হাজার সাহসী মোঘল সেনার প্ৰাণনাশ হয়েছে।
তার কাপুরুষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, তিনি তার শিশুসন্তানকে ফেলে পালিয়ে গেছেন। পারস্যে। সেই শিশুসন্তানকে এখন আমরা আদর এবং মমতায় প্রতিপালন করছি।
রাজ্যশাসনে আমার এই ভ্রাতা সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। সবসময় আফিমের নেশায় আচ্ছন্ন থাকেন বলে তার জগৎ বাস্তবতার বাইরের জগৎ।
আপনি নিশ্চয়ই অবগত যে, আমার এই ভ্রাতা আধাবেলার জন্যে একজন মিসকিন ভিসতিওয়ালাকে দিল্লীর সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এতে তিনি নিজে হাস্যম্পদ হয়েছেন, মোঘলদের ছোট করেছেন।
আপনার কাছে আমার অনুরোধ, আপনি আমার এই অযোগ্য অকৰ্মণ্য ভ্রাতাকে আমার হাতে তুলে দিন। বিনিময়ে আমি কান্দাহার আপনার হাতে তুলে দেব।
বর্তমানে দিল্লীর শাসনভার শের শাহ পুত্র ইসলাম শাহ’র হাতে। আমি নিশ্চিত আল্লাহপাকের হুকুমে আমি তাকে পরাজিত করে হিন্দুস্থানে মোঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত করব। অৰ্কমণ্য নেশাগ্রস্ত হুমায়ূন জীবিত থাকা অবস্থায় এটা সম্ভব হবে না।
এই পত্র আমি আমার তিন ভাইয়ের সম্মতিতে লিখছি। রাজমহিষীরা আমার সঙ্গে আছেন।
ইতি
মীর্জা কামরান
ফজরের নামাজের পরপরই মীর্জা কামরানের দেহরক্ষী দলের প্রধান সুলতান মুহাম্মদকে পারস্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো। গোপন এই চিঠির খবর মীর্জা আসকারিও জানল না।