হরিশংকর চমকে তাকালেন। তাঁর পেছনেই আকিকা বেগম। আকিকা বেগমের হাত ধরে আছে অম্বা। দু’জনের মুখই হাসি হাসি।
হুমায়ূন তুষারঝড়ে পড়েছেন। ঘোড়া চলতে পারছে না। চারটা ঘোড়াকে গোল করে দাঁড় করিয়ে হুমায়ূন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ঘন হয়ে তুষার পড়ছে। এক হাত দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না।
হঠাৎ হুমায়ূনকে চমকে দিয়ে হামিদা বানু শব্দ করে হেসে ফেললেন।
হুমায়ূন বললেন, হাসছ কেন?
আমার ছেলেটা তাঁবুর ভেতর গরমে আরাম করে আছে। এই ভেবে শান্তি লাগছে। শান্তির আনন্দেই হাসছি। এখন আমাকে একটা শের শোনান। শের শুনতে ইচ্ছা করছে।
তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছ?
শের না শুনলে পাগল হয়ে যাব।
কাছেই কোথায় যেন আগুন জ্বলছে। এটা কি চোখের কোনো ভুল? মানুষ মরীচিকা দেখতে অভ্যস্ত। মরুভূমিতে পানির অভাব হলে চোখের সামনে নকল পানি দেখা যায়। শীতে পর্যুদস্ত হয়েছেন বলেই কি নকল আগুন!
জাহাঁপনা!
কে?
আমি বৈরাম। জঙ্গলের ভেতর একটা ঘর পাওয়া গেছে। আমি আগুন জ্বলিয়েছি। আপনারা আসুন। খুব সাবধান। বরফ জমে সব পিচ্ছিল হয়ে আছে।
হুমায়ূন স্ত্রীর হাত ধরে এগুচ্ছেন। যত দ্রুত সম্ভব আগুনের পাশে দাঁড়াতে হবে। ঝড়ের গতি আরও বাড়ছে।
হুমায়ূন হতাশ গলায় বললেন, হামিদা বানু, আমি এই জীবন আর টানতে পারছি না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সব ছেড়েছুড়ে পবিত্র মক্কা শরীফে চলে যাব।
হামিদা বানু বললেন, পরাজিত মানুষের মতো কথা বলছেন?
আমি তো পরাজিত মানুষই। পারস্যের ভেতর দিয়ে আমি মক্কা চলে যাব। আমার সঙ্গে কাউকে যেতে হবে না। আমি একা যাব। বৈরাম খাঁ।
জাহাঁপনা, আমি আপনার কথা শুনছি।
পারস্য-সম্রাট কি তাঁর রাজ্যের ভেতর দিয়ে আমাকে মক্কা যেতে দেবেন?
অবশ্যই দেবেন। তবে এই চিন্তা। আপাতত বন্ধ রাখুন। আসুন আগুনের পাশে যাই।
পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্প
পারস্য-সম্রাট শাহ তামাস্প এবং রাজ্যহারা হুমায়ূন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন। পারস্য-সম্রাট তাঁর জাঁকজমক দেখিয়ে হুমায়ূনকে অভিভূত করতে চাইছেন। অপূর্ব বেশভূষায় সজ্জিত খোজারা পুষ্পবৃষ্টি করল। সামরিক বাদ্যবাজনা হচ্ছে। ঘোড়সওয়ার বাহিনী সালাম জানিয়েছে। এগিয়ে আসছে হন্তীবাহিনী। চারদিকের হইচইয়ের মধ্যে হুমায়ূনকে দীনহীন দেখাচ্ছে।
শাহ তামাস্প বললেন, তৈমুরের বংশধর সম্রাট বাবরের পুত্র হিন্দুস্থানের অধিপতির এই দশা কেন?
হুমায়ূন বললেন, আমার ভাইদের কারণে এই দশা।
সিংহাসনে বসেই ভাইদের হত্যা করলেন না কেন?
সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না।
শাহ তামাস্প বললেন, সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না বলেই কেউ সম্রাট, কেউ পথের ভিক্ষুক। আপনি আমার কাছে কী চান?
হুমায়ূন বললেন, আমি আপনার করুণা চাই না। আমি শুধু পারস্যের ভেতর দিয়ে মক্কা চলে যাওয়ার অনুমতি চাচ্ছি।
আমি যতদূর জানি আপনি সুন্নী মতাবলম্বী।
ঠিকই জানেন। আমার স্ত্রী হামিদা বানু শিয়া।
আপনার স্ত্রী চাইলেই মক্কা যেতে পারবেন। আপনাকে মক্কা যেতে হলে শিয়া মতাবলম্বী হতে হবে। আপনি হয়তো জানেন না, আমি পারস্য সুন্নিমুক্ত করার পরিকল্পনা করেছি। যেসব সুন্নি শিয়া-মতবাদ গ্রহণ করছে না তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে।
হুমায়ূন বললেন, আমাদের নবিজি। (দঃ) বিদায় হজের ভাষণে ধর্মবিষয়ে সহনশীল হতে বলেছেন।
তামাস্প বললেন, এই ধরনের কোনো কথা হযরত আলী বলেন নি। আমরা শিয়ারা হযরত আলীর মতামতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকি। যাই হোক, এখন আমি ধর্মবিষয়ে আলোচনায় উৎসাহী না। পথশ্রমে আপনি ক্লান্ত। ক্লান্তি দূর করুন। সন্ধ্যাবেলা আপনার সম্মানে রাজকীয় ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। আপনার শিয়া-মতবাদ গ্ৰহণ বিষয়ের আলোচনা তখন হবে। আপনার পরিধেয় বস্ত্রের যে অবস্থা তা পরে রাজকীয় ভোজসভায় যেতে পারবেন না। আপনার জন্যে পোশাক সরবরাহ করা হবে।
হুমায়ূন বিষণ্ণ মনে তাঁর জন্যে খাটানো তাঁবুতে ঢুকলেন। হামিদা বানুর জন্যে আলাদা তাঁবু খাটানো হয়েছে। তামাস্প’র হেরেমের নারীরা তার দেখভাল করছে।
শাহ তামাস্প নিজের তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর সামনে দমীহ নামের পারস্যের বিখ্যাত সুরা। মাঝে মাঝে তিনি সুরার পাত্রে চুমুক দিচ্ছেন। বৈরাম খাঁকে ডেকে আনা হয়েছে। বৈরাম খাঁ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁকে বসার অনুমতি দেওয়া হয় নি।
আপনি হুমায়ূনের প্রধান সেনাপতি?
জি আলামপনা। আপনাকে দেখে প্রধান সেনাপতি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আপনি
মেষপালক।
আপনার কথায় সম্মানিত বোধ করছি। আমাদের নবিদের সবাই কোনো-না-কোনো পর্যায়ে মেষপালক ছিলেন।
আপনি শিয়া মতাবলম্বী?
জি জাহাঁপনা।
আপনার মাথায় শিয়াদের লম্বা টুপি নেই কেন? মাথার চুলও তো শিয়াদের মতো কাটা না। রাজকীয় ভোজসভায় আপনি উপস্থিত থাকবেন, তখন যেন মাথায় শিয়াদের টুপি থাকে।
বৈরাম খাঁ বললেন, এই কাজটা আমি মহান সম্রাট হুমায়ূনের অনুমতি ছাড়া করতে পারব না।
তামাস্প কঠিন গলায় বললেন, আপনার মহান সম্রাট হুমায়ূন নিজেই শিয়া টুপি পরে ভোজসভায় আসবেন। তাঁকে পরিধেয় বস্ত্রের সঙ্গে এই টুপিও পাঠানো হয়েছে।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমার সম্রাট ভোজসভাতে যদি মাথা ন্যাড়া করে আসেন, আমি মাথা ন্যাড়া করেই যাব।
আপনার মতো এত অনুগত সেনাপ্রধানের কারণেই হয়তো হুমায়ূন সব কয়টি যুদ্ধে হেরেছেন। শুনেছি প্ৰাণে বাঁচার জন্যে হুমায়ূনকে কয়েকবার পানিতেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছে। তখন আপনি নিশ্চয়ই তার সঙ্গে সাঁতার কেটেছেন?