পুত্রসন্তানের জন্মসংবাদ হুমায়ূনকে দেন। জওহর আবতাবচি। হুমায়ূন আবতাবচিকে বলেন, তোমার কাছে আমি যে মৃগনাভিটি গচ্ছিত রেখেছি সেটা নিয়ে আসো, আর একটা ছুরি আনো।
জওহর আদেশ পালন করলেন। হুমায়ূন নিজের হাতে মৃগনাভি ভাগ করে তার সঙ্গী আমীরদের হাতে দিয়ে বললেন, আজ আমার চরম দুঃসময়। আমি পুত্রের জন্মের আনন্দ করব, আপনাদের সবাইকে উপহার দেব, সে সামর্থ্য আমার নেই। মৃগনাভির একটি করে টুকরা আপনাদের দিলাম। আপনারা প্রার্থনা করুন যেন আমার পুত্রের যশ মৃগনাভির সৌরভের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
কান্দাহার দুর্গে মীর্জা হিন্দালকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। কামরানের হঠাৎ ধারণা হয়েছে তার এই ভাই হুমায়ূনের প্রতি অনুগত। সুযোগ পেলেই সে হুমায়ূনের সঙ্গে যোগ দেবে। হিন্দালকে ভয় দেখানোর জন্যে কামরান চারজন সাধারণ প্ৰজাকে ধরে এনে ঘোষণা করলেন, এরা হুমায়ূনের প্রতি অনুরক্ত। শাস্তি হিসেবে এদের চোখ উৎপাটন করা হবে। চোখ উৎপাটনের এই কাজটা করব আমি নিজে।
তা-ই করা হলো। এই চারজনের বিকট চিৎকার যেন মীর্জা হিন্দাল শুনতে পারেন। সেই ব্যবস্থাও করা হলো।
চোখ উৎপাটিত চারজনকে রাখা হলো মীর্জা হিন্দালের আশপাশে।
কামরান মীর্জা আসকারিকে পাঠালেন হুমায়ূনকে ধরে আনার জন্যে।
জানুয়ারি মাসের শুরু।
শিশুপুত্র এবং সঙ্গীদের নিয়ে হুমায়ূন আবার পথে নেমেছেন। খবর পেয়েছেন জালাল খাঁ নিজে তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছেন। পথে নামা ছাড়া উপায় কী? প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। শিশুপুত্রকে বুকে জড়িয়ে হামিদা বানু স্বামীর পাশে পাশে যাচ্ছেন। পশ্চিম দিক থেকে বাতাসের ঝাপ্টা আসছে। ঘোড়া সেদিকেই যাচ্ছে। হামিদা বানু বললেন, আমি জানতে চাই আমি কোথায় যাচ্ছি?
হুমায়ূন জবাব দিলেন না, কারণ তাঁর কাছে জবাব নেই। তিনি নিজেও জানেন না কোথায় যাচ্ছেন।
হামিদা বানু বললেন, আর কিছুক্ষণ এভাবে চললে আমার ছেলে শীতে জমে যাবে।
হুমায়ূন যাত্রাবিরতির আদেশ দিলেন। অমরকেটের রাজা উপহার হিসেবে ভেড়ার চামড়া জোড়া দিয়ে তৈরি একটি তাঁবু হামিদা বানুকে দিয়েছেন। প্রচণ্ড শীতেও এই তাঁবুর ভেতরটা উষ্ণ থাকে।
তাঁবু খাটানোর হয়েছে। শিশুপুত্রকে বুকে নিয়ে হামিদা বানু তাঁবুর ভেতর ঢুকেছেন। তাঁবুর সামনে আগুন করা হয়েছে। হুমায়ূন আগুনে হাত-পা গরম করার চেষ্টা করছেন। শীতে কাহিল অচেনা একটা পাখি আগুনের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। মানুষের ভয়ে সে এখন আর ভীত না। হুমায়ূন অনেকখানি সরে পাখিকে জায়গা করে দিলেন। তখনই খবর এল। হুমায়ূনের ভাই মীর্জা আসকারি বিশাল বাহিনী নিয়ে হুমায়ূনকে ধরে নিয়ে যেতে আসছেন।
হুমায়ূন হামিদা বানুকে সঙ্গে নিয়ে সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে গেলেন। তাঁবুর ভেতর আছে শিশু আকবর এবং ধাই মিশা। তাঁবুর বাইরে অপেক্ষা করছে জওহর আবিতাবচি। হুমায়ূন জওহর আবিতাবচিকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন সে যেন নিজের হাতে শিশু আকবরকে মীর্জা আসকারির হাতে তুলে দেয় এবং শিশুর জীবন ভিক্ষা চায়।
মীর্জা আসকারি তাঁবুর সামনে উপস্থিত। তাঁবুর ভেতর থেকে শিশুর কান্নার আওয়াজ আসছে। তাঁবুর সামনে মাথা নিচু করে জওহর আবতাবচি দাঁড়িয়ে আছে। আসকারি বললেন, তাঁবুর ভেতরে কে?
জওহর বলল, মহান সম্রাট হুমায়ূনের পুত্র শাহজাদা আকবর।
হুমায়ূন কোথায়?
আমি জানি না জনাব।
কোনদিকে গেছেন এটা নিশ্চয়ই জানো?
হ্যাঁ জানি, কিন্তু আপনাকে বলব না।
শিশুকে নিয়ে আসো।
জনাব আমি নিজের প্রাণের বিনিময়ে এই শিশুর জীবন ভিক্ষা চাচ্ছি।
তোমাকে বলছি শিশুটিকে নিয়ে আসতে। হুকুম পালন করো।
জওহর শিশু আকবরকে কোলে করে নিয়ে এল।
আসকারি শিশুকে নিয়ে কান্দাহার চলে গেলেন।
কান্দাহার দুর্গে সুন্দর একটি নাটক অভিনীত হলো। আসকারি তাঁর স্ত্রীকে (ইনোলা বেগম) ডেকে পাঠিয়ে বললেন, এই শিশুটির নাম আকবর। তার বাবা-মা তাকে ফেলে পালিয়ে গেছেন। এই শিশুটির সব দায়িত্ব তোমাকে দিলাম। সে যেন বাবা-মা’র অভাব কোনোদিন বুঝতে না পারে।
ইনাহা বেগম পরম মমতায় শিশু আকবরকে কোলে তুলে নিলেন।
আচার্য হরিশংকর মেঝেতে উবু হয়ে বসে আছেন। তাঁর বা পায়ের মাংস খুলে খুলে পড়তে শুরু করেছে। তিনি ভীত চোখে একবার তাকাচ্ছেন পায়ের দিকে একবার তাকাচ্ছেন খাটে বসা আকিকা। বেগমের দিকে। আজ সে একা এসেছে। তার বান্ধবী অম্বা আসে নি। সে সব দিন আসে না।
আকিকা বেগম বলল, আপনার কুণ্ঠ হয়েছে?
না। বাত রোগ। খারাপ বাত রোগে এ রকম হয়।
বাত রোগ না, আপনার কুষ্ঠ হয়েছে। এর চিকিৎসা আমি জানি।
কী চিকিৎসা?
পা আগুনে পুড়ানো। বড় করে আগুন করুন। সেই আগুনে আপনার পা ঢুকিয়ে দিন।
চুপ।
আমাকে ধমকাবেন না। আমি হিন্দুস্থানের সম্রাট হুমায়ূনের মেয়ে। এখন বলুন আমার বাবা কোথায়?
আমি জানি না।
কেন জানেন না?
হরিশংকর ঘর থেকে বের হলেন। গঙ্গার তীরে কিছুক্ষণ বসে থাকবেন। ডান পা গঙ্গার পানিতে ড়ুবিয়ে রাখবেন। যে পবিত্র গঙ্গা স্পর্শ করে থাকে, তার কাছে প্রেতিযোনি আসতে পারে না।
হরিশংকর গঙ্গায় ডান পা ড়ুবিয়ে ঘাটে বসে আছেন। গঙ্গার পানি গরম, কিন্তু তার গায়ের ওপর দিয়ে হিমশীতল বাতাস বইছে। তিনি একমনে শব্দ করে রাম নাম আবৃত্তি করছেন। প্রেতিযোনি রাম নামে ভীত হয়।
আমার বাবা সম্রাট হুমায়ূন কোথায়?